My Stories

চটকলের সে রাত

(১)

“চ ট ক ল – কোথাও কোন আকার নেই আর যার আকার নেই সে তো নিরাকার – তার তো কোন পরিবর্তন হয় না। তাই চটকলেরও কোন পরিবর্তন নেই। একশ বছর আগেও যা ছিল আজও তাই আছে” – কথাগুলো আমায় বলেছিলেন চটকলেরই এক ভদ্রলোক মিঃ শিবব্রত সামন্ত। বেশ মজার মজার কথা বলতেন। তখন উনি একটা জুট মিলের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার ছিলেন। জুট মিলের লোকেরা চটকল বলতেই বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করে। চটকলের মধ্যশ্রেণী থেকে উচ্চশ্রেণীর কর্মীরা এক যায়গায় বেশী দিন থাকেন না। বিভিন্ন চটকলে ঘুরে ফিরে বেড়ান। এই জন্য কোথাও একজনের সাথে আর একজনের দেখা হলে প্রথমে ‘কেমন আছেন’ বলে না – বলে ‘এখন কোথায় আছেন’।    

আমি তখন ভারত সরকারের অর্থে পুষ্ট একটি পাট গবেষণা সংস্থায় চাকরি করি। নিজের গবেষণার কাজে মাঝে মাঝেই আমাদের নানান জুটমিলে যেতে হয় – বাস্তব প্রয়োগের ফল কি রকম হবে তারই পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য। এ সব ব্যাপারে অবশ্য মিলের ম্যানেজার, সুপারভাইসার ও অন্যান্য কর্মচারিরাও আমাদের খুবই সাহায্য করেন। সাধারণতঃ অফিসের গাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে মিলে দেওয়া-নেওয়া করে। এক পথের যাত্রা আড়াই-তিন ঘন্টার কমে’ত হয়ই না। মিলে পৌঁছতে, পৌঁছতে এগারোটা বেজে যায়। সে সময়ে আবার মিলের শিফট চেঞ্জ হয় – সকাল ছটার ‘এ’ শিফটে যারা কাজে এসেছিল – এখন সাময়িক বিরতি বেলা দুটো পর্য্যন্ত। এবার ‘বি’ শিফট – চলবে দুটো থেকে পাঁচটা আবার পাঁচটা থেকে রাত্রি দশটা। ‘সি’ শিফট রাত দশটা থেকে ভোর ছ’টা। কলের চাকা বন্ধ হয় না। প্রায় হাজার চারেক শ্রমিক কাজ করে।

যদি কোন দিন মিলের গেটে পৌঁছতে এগারোটা হয়ে যায় – বাস হয়ে গেল। হাজারের ওপর শ্রমিক গেট দিয়ে বেরোবে – সে রাস্তা পরিস্কার হ’তে অন্তত মিনিট পনেরো। আমরাও গাড়ি নিয়ে ঠায় গেটের বাইরে। এর পর গিয়ে দেখব কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার বড় সাহেবের ঘরে গেছেন। তিনি আসবেন – তাকে আমি কি করতে চাই বোঝাব। ইতিমধ্যে চা, প্লেটে মিষ্টি, কাজুবাদাম সব আসবে – তার সাথে ক্লাসিক সিগেরেটের আনকোরা প্যাকেট আর দেশলাই। ম্যানেজার এর পর আমার কাজে সাহায্যের জন্য লোকের যোগাড় করবে, মিলের ভেতরে যে মেশিনে কাজ হবে তার সব বন্দোবস্ত করা, আমার একটা মাপার যন্ত্রের ইলেকট্রিক্যাল কানেকশন করতে হবে তার জন্য চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে বলে ইলেকট্রিশিয়ান ধরে আনা  – এ সব করতে করতে প্রায় সাড়ে বারটা – পৌনে একটা। আর কি “এবার লাঞ্চে চলুন” – ম্যানেজারকে নিয়ে গাড়ি করে গেস্ট হাউস। চর্ব্ব, চোষ্য, লেহ্য, পেয়ো –  গল্প, ধুমপান সব সেরে মিলে আসা হল প্রায় দুটো। হায় রে আবার শিফট চেঞ্জ। সহযোগী যাদের দেওয়া হয়েছিল আবার তাদের খবর দিয়ে ধরে এনে কাজ শুরু করতে করতে তিনটে। পাঁচটায় আবার শিফট চেঞ্জ। সহকারিদের ছুটি – ওভারটাইমতো পাবে না – সুতরাং কিসের ইন্টারেস্ট? আমাদেরও ফিরতে হবে – বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে আটটা-সাড়ে আটটাতো হবেই। ড্রাইভারের গাড়ি অফিসে রেখে বাড়ি যেতে যেতে রাত দশটা। আবার পরদিন মিল – আবার সেই অ-এ অজগর আসছে তেড়ে থেকে শুরু। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয় না – এ ব্যাপারে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। শুধু মিলে যাতায়াতটাই সার হয়।  

বছর কয়েক হ’ল মাত্র চাকরীতে ঢুকেছি। আমি এতদিন যে সব কাজ করছিলাম তা’তে জুটমিলে আসার দরকার হয় নি – ওই ক’য়েকবার সহকর্মীদের সাথে এসেছিলাম জুটমিলের কাজের জ্ঞানলাভ করতে। এবারে যে রিসার্চ প্রোজেক্টটা হাতে নিয়েছি তা’তে ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে আর কারখানার বাস্তব পরিবেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কতটা তফাৎ হয় তা জানা দরকার। তাই এবার ঠিক করেছি রোজ যাতায়াত করে নয় – জুটমিলে ক’দিন থেকে কাজ করব।

আগে থেকে যোগাযোগ করে যে মিলটা ঠিক করেছিলাম সেটা উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুর সাবডিভিশনের জগদ্দল অঞ্চলে হুগলি নদীর পারে এডোয়ার্ড জুট মিল। একসময়ে হেনরী স্টুয়ার্ট এন্ড কোম্পানির মিল ছিল। কয়েকবার হাত ফেরতা হয়ে এখন মালিক একজন সিন্ধি ভদ্রলোক – পঙ্কজ মেঙ্ঘানি। তাঁর আরও দুটো জুট মিল আছে। এই শ্যামনগর-জগদ্দল অঞ্চলে মৌমাছির ঝাঁকের মতন থিক থিক করছে যত চটকল – অকল্যান্ড, মেঘনা, অ্যালায়েন্স, অ্যাংলো ইন্ডিয়ার তিনটে মিল, কাঁকিনাড়া, রিলায়েন্স। নদীর ওপারটা চন্দননগর আর হুগলির মাঝামাঝি। ওপারেও বালি থেকে ব্যান্ডেল পর্য্যন্ত লাইন ধরে জুট মিল।

আমাদের গবেষণাগারের আর এই জুট মিলগুলোর মধ্যে সাধারণতঃ সংযোগকারি আধিকারিক মিলের কোয়ালিটি কন্ট্রোল ম্যানেজার। আমরা গেলেই উনিই যাবতীয় দেখভালের দায়িত্বে থাকেন। আমার যারা সহকর্মী – দীর্ঘ দিন চাকরী করছেন – তাদের দেখতাম মিলের কাজের ব্যাপারে তারা সব যোগাযোগ এই ম্যানেজারের সাথেই করতেন – তাদের সাথে কাজের সুবাদে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তবুও কেন জানি না তারা কাজ করতে গিয়ে যথেষ্ট অসুবিধাও ভোগ করতেন। মিলের কাউকে ঠিক চিনিওনা। আমি সোজা মিলের চিফ এক্সিকিউটভের সাথে আগে থেকে চিঠি লিখে ও ফোনে কথা বলে রেখেছিলাম।  

(২)

দিন তারিখ সাল কিছুই ভুলি নি – ভোলার কথাও নয় – সোমবার, ২৪শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯০। প্রয়োজনীয় সব ইনস্ট্রুমেন্টস, জিনিষপত্র নিয়ে আমি সকাল সকালই মিলে পৌঁছেছিলাম। আমার অফিসের গাড়ি আমাকে যখন মিলের অফিসের সামনে নামিয়ে দিল তখন সকাল দশটা। অন্যান্য সময়ে গাড়ি সারাদিনই মিলে থাকে বিকেলে ফেরার জন্য। আমার এবার ফেরার ব্যাপার নেই –তিন চার দিন থাকব। ড্রাইভার বনোয়ারী গাড়ি নিয়ে অফিস ফিরে যাবে।

মিলের অফিসটা একতলা। দেখলেই বোঝা যায় – শতাধিক বছরের প্রাচীন সৌধ। মোটা মোটা দেয়াল, লম্বা টানা চওড়া বারান্দা, মাঝে মাঝে উঁচু আর্চ। বারান্দা পেরোলেই বিশাল হলঘর। পেল্লাই পেল্লাই জাফ্রি কাটা দরজা – নোনা ধরা ঘরের দেয়াল, দরজা কতকাল যে রঙ হয় নি কে জানে। সারি সারি নানা রকম কালছে মারা টেবিল চেয়ার, স্তুপিকৃত ফাইল, কাগজপত্র। দেয়াল, ঘর সবেতেই কি রকম একটা ভ্যাপসা গন্ধ – খুব পুরানো বাড়িতে যেমন পাওয়া যায়। চেয়ারে বসা কর্মচারীদের দেখলে মনে হয় চাকরীতো নয় – দিনগত পাপক্ষয় করছে। এর আগে জুটমিল কয়েকদিন ঘুরে একটা জিনিষ বুঝেছিলাম এখানে হাবভাব, ব্যাবহার, কথাবার্তায় সাম্যবাদ নয় কিছুটা ফিউডাল মনোভাবে কাজ হয় বেশী। সেই যে কোন এক জুটমিলের বড়া সাহাব একবার আমাকে হাসতে হাসতে বলেছিলেন – “ইয়ে চটকল হ্যাঁয়, হামে টেকনোলজি নেহি ডান্ডালজিসে জাদা কাম হোতা”।

চিফ এক্সিকিউটিভ মিঃ ডি কে সোমানি। মেইন অফিসেই বসেন। আমি বারান্দা ধরে একটু এগোতেই একজন দশাসই চেহারার হিন্দুস্থানি দারোয়ান, খাকি ড্রেস পরা – জামায় ইংরেজিতে লাল মনোগ্রাম করা এডোয়ার্ড জুট মিল – আমাকে দেখে এগিয়ে এল। এর কারণ আছে – আমাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে। এ যদি আমি গেট দিয়ে হেঁটে ঢুকতাম – তা’ হলে আর আসতো না। আমি গম্ভীর ভাবে একটু ভুরূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলাম –“মিঃ সোমানি?”। দারোয়ান “হা, সাব – আইয়ে বলে” বলে আমাকে সোমানির ঘরের কাছে নিয়ে গেল। ভেজানো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ইতস্তত করছে দেখে আমি আমার একটা ভিসিটিং কার্ড দিলাম। সে সেটা নিয়ে ভেতরে চলে গেল। প্রায় সাথে সাথে বেরিয়ে এসে “আইয়ে সাব” বলে ঘরের ভেতর নিয়ে এল।     

বিশাল বড় ঘর – হাল্কা পিস্তা রঙের প্লাস্টিক পেইন্ট করা। দেয়ালে প্রায় তিন বাই দুই ফুট সাইজের বাঁধান গণেশের ছবি। আর এক দিকের দেয়ালে এক ফুট বাই তিন ফুটের বাঁধান ছবি – নদীর তীর বরাবর টানা লম্বা এডোয়ার্ড জুটমিলের কালো-সাদা ফটোগ্রাফ – ১৯২৮ সালে তোলা। বড় টেবিল ভর্তি ফাইল কাগজ, ডায়েরী – পেন স্ট্যান্ড, ডেট ক্যালেন্ডার, গোটা তিনেক ফোন। এক্সিকিউটিভ হাই ব্যাক চেয়ারে বসা মিঃ সোমানি। সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট পরা। জুট মিলে দেখেছি সে চিফ এক্সিকিউটিভ থেকে শুরু করে সুপারভাইসার, ওভারশিয়ার সবাই সাদা জামা সাদা প্যান্ট পরে। ওটা ড্রেস।  ফর্সা দোহারা চেহারা। মাথার সামনেটা পাতলা হয়ে এসেছে। নিঁখুতভাবে দাড়িগোফ কামান। চোখে রিমলেস চশমা। বয়স আন্দাজ পঞ্চান্নর আশেপাশে। চেহারায়, চোখেমুখে হাবে ভাবে বেশ সুস্পষ্ট কর্তৃত্বের ভাব। টেবিলের কাছে একজন পিয়ন শ্রেনীর লোক দাঁড়িয়ে – উনি একটা চেক বইয়ের পাতা সই করে যাচ্ছেন। আমি ঢুকতে মুখটা একটু তুলে হাত দিয়ে ইশারা করে এসে বসতে বললেন। চেক ও আরও কয়েকটা কাগজে সই সাবুদ শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “হাঁ, আমি আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনি কি খাবেন বলুন – চায়, কফি কুছ ঠান্ডা – নাস্তা করবেন তো”? বাঙলা ভালই বলেন তবে ঐ অবাঙালি টান।   

আমি বললাম – “না। আমি শুধু কফি খাব”।

সোমানি একটা বেল টিপতেই ওই দারোয়ান আবার এল। তাকে বললেন – “সাব কে লিয়ে কফি। মিঃ সামন্তকো বুলাও অউর ঘোষ সাহাবকো ভি”। আমায় বললেন – “হাঁ আপনি আমাদের এখানে এক্সপেরিমেন্ট করুন…বাট আপনি এক্সাক্টলি কি করতে চাইছেন?”

আমি জানি সাধারণতঃ জুট মিলের কর্ত্তাব্যক্তিদের কাছে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্টের খুব একটা গুরুত্ব নেই। কোয়ালিটি কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টটা রাখতে হয় তাই। তাঁদের কাছে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ – প্রোডাকশন বাড়ানো, লেবার ছাটাই করা আর এক্সপোর্ট বা সরকারি অর্ডার যাই হোক কি করে ইন্সপেকশন পাশ করাতে হবে। প্রায় সব জুটমিলগুলো আমাদের ইন্সটিটিউটের সদস্য। তাই আমরা মিল ট্রায়াল বা এক্সপেরিমেন্টের জন্য গেলে ঠিক না করতে পারে না। আমি মোটামুটি আমার কাজটার কি উদ্দেশ্য, কেন করছি, কি ভাবে করছি, এতে জুটমিলের কি লাভ হবে – একটু বিশদভাবেই বললাম। প্রথমটা একটু হাল্কাভাবেই শুনছিলেন পরে দেখলাম বেশ মন দিয়েই শুনছেন। ইতিমধ্যে একজন বেয়ারা এসে কফি আর এক প্লেট সল্টেড কাজুবাদাম দিয়ে গেল। খানিকটা শুনে সোমানি আমায় বললেন – “এটাতো ভেরি গুড প্রোজেক্ট – আপনি করুন – আমার মিলেই করুন। যে কদিন লাগে – কোন অসুবিধা হবে না”।    

দরজা ঠেলে ঘরে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। সাদা প্যান্ট সাদা শার্ট পরা। বুঝলাম ইনিই মিঃ সামন্ত। ঢ্যাঙা লম্বা, রোগাটে গড়ন, শ্যামলা রঙ। মাথায় কালো ঘন চুল, উল্টিয়ে আঁচড়ানো। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। বয়স চল্লিশ না পঞ্চাশ বোঝার কোন উপায় নেই। হাতে দেখলাম সোমানিকে পাঠানো আমার চিঠিটা। আমার দিকে একগাল হেসে একটু মাথা ঝুঁকিয়ে চেয়ারে বসলেন। সোমানি মিঃ সামন্তকে বললেন – “ডক্টর সাব আমাদের মিলে একটা এক্সপেরিমেন্ট করবেন – আপনি ওনাকে সব রকম হেল্প করবেন – ওনার যা লাগবে। আপনার একজন এসিস্ট্যান্টকে ওনার সাথে দিয়ে দিন আর দু জন লেবার…আসুন ঘোষ সাহাব”।

আমি পেছন ফিরে দেখলাম একজন বয়স্ক ভদ্রলোক ঢুকলেন। টেরিকটের সাদা প্যান্ট-শার্ট পরা। বেশ আভিজাত্যপুর্ণ গুরুগম্ভীর চেহারা। স্বাস্থ্যবান, ফরসা, মাঝারি লম্বা, মাথায় ঘন সল্ট-পিপার চুল, চোখে হেক্সাগনাল রিমলেস চশমা। আমার ডান পাশের চেয়ারে বসলেন। মিস্টার সোমানি আমাকে দেখিয়ে মিস্টার ঘোষকে বললেন – “মিট ডক্টর ব্যানার্জ্জী – আমাদের ইজিরা থেকে এসেছেন – এখানে উনি স্পিনিং ফ্রেমে কিছু এক্সপেরিমেন্ট করবেন – তা আপনার কিছু হেল্প লাগবে”। এবার সোমানি আমার দিকে ফিরে বললেন – “মিঃ ঘোষ – আমাদের চিফ ইঞ্জিনিয়ার – আপনার কাজ উনি বেটার বুঝবেন – হি ইস দা বেস্ট পারসন”।

মিস্টার ঘোষ একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে আমার দিকে একটু ফিরে বললেন – “আপনি… আজই করবেন? আপনার… কাজটা কি যদি বলেন…”।

সোমানি সাথে সাথে বললেন – “ ডক্টর সাব এখানে আমাদের গেস্ট হাউসে কদিন থাকবেন। সামন্ত সব দেখাশুনা করবে। আপনি, সামন্ত ওনার সাথে এ ব্যাপারে একটা মিটিং করে সব ডিসকাস করে নিন। আমিও থাকতাম কিছু শেখা যেত। কিন্তু আমাকে এখনই হেড অফিসে যেতে হবে। আপনিতো এখন আছেন। আমি যাব আপনার এক্সপেরিমেন্ট দেখতে”। আমি মনে মনে হাসলাম। মুখে যতই উৎসাহ দেখাক – জুট মিলে জীবনেও নতুন কোন আইডিয়া বা টেকনোলজি ঢুকবে না। ঐ ডাণ্ডালজি দিয়ে আর সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যতদিন চলে চলবে – তারপর ইনকিলাব জিন্দাবাদ, ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের গরম গরম লেকচার, স্ট্রাইক, ঘেরাও, লক আউট। শ্রমিকদের পাওনা গণ্ডা না দিয়ে, প্রভিডেন্ট  ফান্ডের টাকা মেরে মালিক একদিন মিল বেচে দিয়ে ছু মন্তর হয়ে যাবে। যাক এত সব ভেবে লাভ নেই। আমার কাজটা বাবা উদ্ধার করে দাও। আমারওতো কেরিয়ার আছে।

ঘোষ সাহেব একটু পরে মীটিং করবেন বললেন। ওনার কিছু পেপার ওয়ার্কস বাকি আছে। বারটার পর  উনি ফোন করলে আমরা পাওয়ার হাউসে ওনার অফিসে চলে যাব। সওয়া এগারটা নাগাদ মিস্টার সোমানির ঘর থেকে বেরিয়ে সামন্তবাবুর সাথে তার কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে এলাম। সব জুটমিলেই এই কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবের একই ছবি। ঢুকতেই চটের বস্তা, সুতোর একটা ডিজেল তেল মার্কা গন্ধ। কয়েকটা মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি – আগেকার দিনের কাঁসার থালার মতন বড় সাদা ডায়াল – কাল দাগ কাটা, নম্বর দেওয়া – যেন কাঁটাওয়ালা বিশাল ঘড়ি। আমাদের ইনস্টিটিউটের ডিজাইন করা গোটা দুয়েক ময়েশ্চার মিটার – পাটে বা চটে কত শতাংশ জল আছে দেখার জন্য। এখানে ওখানে মাটিতে টেবিলে ডাঁই করা হলুদ ছোট কাগজের ট্যাগ মারা কাঁচা পাট, পাটের সুতো জড়ানো ববিন, চটের বস্তা। একদিকের দেয়াল ঘেঁষা উঁচু টেবিলে ক্ল্যাম্পে লাগান লিবিগ কন্ডেন্সার, গোটা দুই বিকার। গোটাতিনেক পুরান টেবিল চেয়ার। একজন একটা ঘরকাটা কাগজ দেখে পকেট ক্যালকুলেটার দিয়ে হিসেব করছে। জুটের মডার্নাইজেসন বলতে ঐ সবেধন ডিজিটাল ক্যালকুলেটার। ঘরের শেষপ্রান্তের ডানদিকে কিছুটা জায়গা কাঠ আর প্লাইউডের পার্টিসন করা – ওটাই সামন্তর চেম্বার।

সামন্ত আমাকে নিয়ে ওর ঘরে বসিয়ে “এই দু’মিনিট আসছি” বলে আবার ঝড়ের মতন বেরিয়ে গেল। সব সময়ে মনে হয় চড়কিপাক খাচ্ছে। আমি চুপচাপ বসে আছি। খানিক বাদে সামন্ত ফিরল। চেয়ারে বসতে বসতেই বলল – “আরে বলবেন না। আমারতো হাজার ঝামেলা। কাল আবার এক্সপোর্ট ইনস্পেক্টার আসবে। টেস্টিঙের জন্য স্যাম্পল রেডি করে রাখতে হবে, ফুলজলের ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। দেবতা তুষ্ট করতে হবে’তো। এনারা রুষ্ট হলে’তো আবার চাকরিটি থাকবে না”। ওনার কথা আর বলার ধরণে আমি হেসে ফেললাম।

সামন্ত বলল – “না সাহেব – এ হাসির কথা নয়। আপনারা রিসার্চ করেন – আপনাদের কথা আলাদা। আমাদের ফুলজল দিয়েই চলতে হয়। আমি যেখানেই কোন নুড়ি-পাথর দেখি – একটু সামান্য ফুলজল দিয়ে দিই – ক্ষতিতো কিছু নেই। কারণ এই নুড়ি পাথর যদি কোনদিন শিবলিঙ্গ হয়ে যায়”।

আমি হেসে বললাম – “তা নুড়ি কখনও শিবলিঙ্গ হয়েছে?”

সামন্ত বলল – “এত তপস্যা কি বৃথা যায়? শুনুন তা’হলে”।

ইতিমধ্যে একটি লোক ট্রেতে করে চা নিয়ে এল। পকেট থেকে ক্লাসিক সিগেরেটের নতুন প্যাকেট আর একটা দেশলাই আমার সামনে রাখল। জুটমিলের এই আতিথেয়তার সাথে আমরা পরিচিত। চায়ে চুমুক দিয়ে প্যাকেট খুলে সিগেরেট নিলাম – সামন্তকেও দিলাম। জুটমিলে এই কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাবে বা অফিসেই শুধু সিগেরেট খাওয়া চলে। অন্যত্র সর্বত্র দেয়া্লে  নোটিস সাঁটান আছে – “ধুম্রপান মানা হ্যাঁয়”।

সিগেরেট ধরিয়ে সামন্ত বলল – “আমি তখন টীটাগড়ের কাছে স্ট্যানডার্ড জুট মিলে কাজ করি। লাঞ্চের পর কোয়াটার্স থেকে রাস্তা পেরিয়ে মিলে ঢুকছি। দেখি আমাদের মিলের ঠিক গেটের সামনে একটা গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। ঠা ঠা রোদ – তার মধ্যে দুজন ভদ্রলোক এই বছর পঁয়তিরিশ-চল্লিশ হবে – আমাদের মিলের দেয়াল ঘেঁষে যে সামান্য একটু ছায়া – সেখানে মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছে। আর ড্রাইভার গাড়ির বনেট খুলে উপুর হয়ে কি দেখছে। গাড়ির নেমপ্লেটের ওপর গভর্নমেন্ট অফ ইন্ডিয়া লেখা। আমার দেখেই মনে হল সরকারি আমলা – নুড়িপাথরতো বটেই। আমি ইচ্ছে করে ওনাদের সামনে একটু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে এগিয়ে এলাম আমাকে দেখে ওনারা বলে উঠলেন – “বলতে পারেন কাছাকাছি কোন মোটর গ্যারেজ বা গাড়ির মেকানিক পাওয়া যাবে কি না?”

আমি বললাম – “আমাদের জুট মিলেরই ভাল মেকানিক আছে – আপনারা আমার সাথে ভেতরে আসুন – আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি”। এই বলে ওনাদের নিয়ে এসে আমাদের অফিসে বড় সাহেবের ঘরের পাশে যে গেস্ট রুম আছে – সেখানে বসালাম। বেয়ারাকে বলে ভাল ফুলজলের ব্যবস্থা করতে বলে আমি মেকানিক নিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। তেমন বিশেষ কিছুই হয় নি। মেকানিক মিনিট কুড়ির মধ্যে গাড়ি ঠিক করে দিল। গাড়ি মিলের ভেতর অফিসের সামনে নিয়ে এলাম। ভদ্রলোক দুজন খুব হ্যান্ডশেক করে গাড়ির জন্য, কফি-কাজুর জন্য বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চলে গেলেন”।

আমি বললাম – “ফুলজলের ফল কি হল?”

সামন্ত সিগেরেটে লম্বা এক টান মেরে তুড়ি দিয়ে অ্যাস্ট্রেতে ছাই ফেলে বলল – “ফুলের সাথে সাথেই ফল হয় নাকি? সে তো সময় লাগে। বছর পাঁচ-ছয় পরে হবে বুঝলেন। আমি মাঝে হাওড়া মিলে বছর তিনেক কাজ করে আবার ওই স্ট্যান্ডার্ড  মিলেই ফিরে এসেছি – ম্যানেজার নই তবে কোয়ালিটি কন্ট্রোলটা আমিই দেখতাম। আগে এক সময়ে এই মিল বার্ড কোম্পানির ছিল। সাহেবরাতো নেই এখন মাড়োয়ারি মালিক। স্ট্যান্ডার্ড মিলের সেই স্ট্যান্ডার্ডতো আর নেই। এমপ্লয়িস প্রভিডেন্ট ফান্ডের একটা কেসে মিল ফেঁসে গেছে। মালিক বা বড় সাহেব একজনতো জেলে যাবেনই। কমিশনারের অফিস থেকে বেশ উঁচুদরের এক আমলা এসেছেন তদন্ত করতে। গাড়ি থেকে নামছেন। আমাদের বাবু মানে মালিক আর প্রেসিডেন্টতো হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে। আমি অফিসের কাছেই ছিলাম। ভদ্রলোককে দেখে একটু চমকে উঠলাম। লক্ষ্য করলাম উনি গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক, তারপর অফিস বিল্ডিং সব দেখছেন। আমি চিনতে পারলাম। এতো আমার সেই নুড়িপাথর। একটু মোটা হয়ে এখন শিবলিঙ্গ হয়ে গেছেন। আমি একটু সাহস করে কাছাকাছি এগিয়ে এলাম যাতে আমার দিকে চোখ পরে। আমকে দেখে উনি একটু ভুরু কুচকে বললেন – “যায়গাটা কি রকম চেনা চেনা লাগছে – আর আপনাকেও কোথাও দেখেছি মনে হচ্ছে”।

আমি একেবারে হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বললাম – “হ্যাঁ স্যার। একবার স্যার… মিলের গেটের কাছে আপনাদের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছিল – আমি আপনাদের এখানে নিয়ে এসেছিলাম স্যার”। ভদ্রলোক আঙ্গুল নেড়ে বলে উঠলেন – “রাইট ইউ আর। মনে পড়েছে। ওঃ সেদিন খুব বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন মশাই”। বলতে বলতে উনি আমাদের বাবু আর বড় সাহেবের সাথে অফিসে যেখানে বাবু মিলে এলে বসেন সে ঘরে এলেন। এটা মিলের সবচেয়ে সাজানো সুন্দর ঘর। আমাদের মিলের বড় সাহেব আমাকে চোখের ইশারায় আসতে বললেন।

দেবতার পূজার জন্যতো ষোড়শোপচারে আয়োজন করে রাখা হয়েছে। সব দেবতা আবার পূজা নেন না। ইনি নেবেন কি নেবেন না সেটা বুঝে নিতে হবেতো। আমি বললাম –“স্যার আপনার জন্য একটু কফি বলি?” উনি একেবারে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন – “না না কোন কিছুর ব্যবস্থা করবেন না”। তারপর কি মনে হল আমার প্রতি কৃপা বশতঃ বললেন –“আচ্ছা ওনলি কফি – নট ইভেন বিস্কিট”। অনেকদিন তো অনেক দেবতা ঘেটেছি। মুখ আর শরীরের ভাষা পড়তে পারি। আমি বেরিয়ে কফির ব্যবস্থা করলাম। বড় সাহেবের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম বাইরে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। ঘন্টাখানেক বাদে সাহেব ফাইলপত্তর নিয়ে বেরোলেন। আমি গিয়ে ওনার গাড়ির দরজা খুলে দিলাম। আমার দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নেড়ে ‘চলি’ বলে শিবলিঙ্গতো চলে গেলেন। যাক কাউকে আর জেলেটেলে যেতে হয়নি। গুরু পাপে লঘুদণ্ড দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। মিল অবশ্য পরে দেবতার আদেশ মতন সব ঝামেলা মিটিয়ে দিয়েছিল। দু’মাস বাদেই আমি ম্যানেজার হয়ে গেলাম”।

আমি হেসে বললাম – “যে ম্যানেজ আপনি করলেন – তার পরে আপনাকে ম্যানেজার না করে পারে”?

সামন্ত বললেন –“ তবে, দেখলেনতো ফুলজলের মাহাত্ম্য”।

(৩)

প্রায় বারটা বাজে। এমন সময়ে টেলিফোন বেজে উঠল। সামন্ত ফোন তুলেই – “হ্যাঁ হ্যাঁ। ও আচ্ছা। আচ্ছা স্যার আমরা এক্ষুনি আসছি”। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “চলুন – ঘোষ সাহেব ডাকছেন। আমরা অফিসেই বসব। বড় সাহেবের পাশের ঘরে – মিটিং রুমে”। আমরা আবার মেন অফিসের দিকে চললাম।

ঘোষ সাহেব এসে গেছেন। হাতে একটা নোট প্যাড। মিটিং রুমটা বেশ বড়, ঘরটা ঠাণ্ডা, তিনটে এসি চলছে – মাঝে একটা বড় ওভাল টেবিল, চারপাশে গোটা দশেক চেয়ার। আমরা একটা ধার ধরে বসলাম। আমি মোটামুটি আমার কাজের সম্বন্ধে একটা ছোটখাটো লেকচার দিয়ে দিলাম। সামন্তকে দেখে মনে হ’ল না খুব একটা ইন্টারেস্ট পাচ্ছে কিন্তু ঘোষ সাহেব খুব মন দিয়ে শুনছেন আর মাঝে মাঝে সুন্দর হাতের লেখায়, ছোট ছোট নোট রাখছেন। বেয়ারা এসে তিন কাপ কফি দিয়ে গেল। ঘোষ সাহেব বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন – আমি আবার সেগুলোর যথাযোগ্য জবাব দিলাম। ঘোষ সাহেব একটু চিন্তা করে বললেন – “আপনার কাজটা তো বেশ ভালই। আমি আর একটু ভেবে নিই – কি ভাবে আপনাকে বেস্ট পসিবল হেল্প দেওয়া যায়। আমি সাড়ে তিনটেয় আসব। মিঃ সামন্ত, আপনি ওনাকে নিয়ে তখন পাওয়ার হাউসে আমার অফিসে চলে আসবেন”। ঘোষ সাহেব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠলেন। লাঞ্চে নিজের কোয়াটার্সে চলে যাবেন। এখন ঠিক একটা বাজে।

মিঃ সামন্ত আমায় বলল – “চলুন স্যার আপনাকে গেস্ট হাউসে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে আসি। আপনার মালপত্র?”

– “গাড়িতে”।

আমাদের দেখে বনোয়ারী গাড়ি নিয়ে এল। ঘোষসাহেব চলে গেছেন। আমি সামন্তকে নিয়ে গেস্ট হাউসে এলাম। বনোয়ারী চেনে – আগে অনেকবার এসেছে। বাস রে! কি পেল্লাই গেস্ট হাউসের বাড়িটা। বাইরে বাফ রঙের দেয়াল, সবুজ রঙের জাফরি দেওয়া বিশাল বিশাল জানালা। দোতলা কিন্তু প্রায় তিন তলার হাইট। কি মোটা দেয়াল! কুড়ি ইঞ্চিতো হবেই – বেশীও হতে পারে। চওড়া সিঁড়ি পাঁচ-ছয় ধাপ বেয়ে উঠলে লম্বা টানা সিমেন্টের বারান্দা – পাশ আট-নয় ফুট। এক দিক থেকে চওড়া চটে যাওয়া এককালের মেহগনি পালিশ করা কাঠের সিঁড়ি দোতলায় যাবার। বারান্দায় সিঁড়ির দু’পাশে তিনটে করে গোটা ছয়েক আর্চ – ওপরের দিকে সবুজ রঙের কাঠের জাফরি।  

আমি থাকব একতলায়। দোতলায় দিন দশেক ধরে একজন বিদেশী গেস্ট আছে – বেলজিয়াম থেকে এসেছে। মিলে বেলজিয়ামের ভ্যান ডি উইলি কোম্পানির তৈরী একটা নতুন জুট-পলিপ্রপিলিন টাফটেড কার্পেট বোনার তাঁত বসছে – এ লোকটি ইঞ্জিনিয়ার – তাঁতটা বসিয়ে চালু করে দিয়ে যাবে। নীচের তলায় তিনটে বড় বড় ঘর – কম করে পাঁচশ থেকে ছ’শ স্কোয়ার ফিট এক একটা ঘর। তেমনি ঘরের হাইট। সিলিং থেকে লম্বা ডাণ্ডা নেমে এসেছে ফ্যানের। বারান্দা পেরিয়ে একটা বড় অ্যান্টিরুম তার একদিকে রান্নাঘর আর উল্টোদিকে আর একটা ঘর। অ্যান্টিরুম পেরিয়ে যে ঘরে ঢুকলাম সেটা ড্রয়িং রুম। এর দুপাশে দুটো  বেডরুম। ডানদিকের ঘরটায় আমার থাকার ব্যবস্থা হ’ল। ঘরের মাঝে বেশ কিং সাইজের ডবল বেডেড খাট – একদিকের দেয়াল ঘেঁষে দুটো কাঠের বড় ওয়ারড্রোব, রাইটিং টেবিল, চেয়ার, একটা সোফা কোচ – সবই সেই ভিক্টোরিয়ান আমলের বার্মা টিকের ফার্নিচার। সংলগ্ন বাথরুম – দশ বাই দশ’ত হবেই। বাথটাব রয়েছে – তবে ব্যবহারযোগ্য নয়।   

ঘরে আমার ইন্সট্রুমেন্টস আর জামাকাপড় ভরা ব্যাগ রেখে সামন্তর সাথে ড্রয়িং রুমে এসে বসলাম। এই ঘরটা সবচেয়ে বড়। এই সাইজের মাঠে আমরা ছোটবেলায় ফুটবল খেলেছি। ঘরের মাঝখানে কার্পেট পাতা – চারপাশে ডবল সোফাসেট। সামনে জানালার দিকে ওভাল আকৃতির ডাইনিং টেবিল, ছ’টা চেয়ার।  দেয়ালের ধার দিয়ে সাইড টেবিল। সামনে ডবল দরজা – ভেতরেরটা খোপ খোপ কাঁচ লাগান কাঠের – বাইরেরটা জাফরি দেওয়া কাঠের। দেয়ালের ওপরে বড় স্কাইলাইট দরজার বাইরে গোল চওড়া বারান্দা – বেডরুম দুটো থেকেও আসা যায়। বারান্দা থেকে সিঁড়ি নেমেছে ইট বাঁধানো রাস্তায়। তার দু’পাশে খানিকটা করে খোলা যায়গা – বাগান। দুটো বড় বড় রঙ্গন ফুলের গাছ আর রাস্তার ধার বরাবর ইটের কেয়ারি করে ক্যানা লিলি, নানা ধরণের ক্রোটন, গোল্ডেন ডুরেন্টা সব সার দিয়ে লাগান। সামনে এই ফুট পঞ্চাশেক দূরে গঙ্গা। পুরো গঙ্গার ধার বরাবর কত রকমের মহীরুহ। তাদের মাঝে মাঝেও আবার বুশ টাইপের গাছ। নদীর ধার বরাবর যতটা জুটমিলের যায়গা পুরোটাই ফুট চারেক পাঁচিল আর তার ওপরে প্রায় সাত-আট ফিট লম্বা মোটা লোহার জাল দেওয়া। মাঝখানে মিলের নিজস্ব জেটি – একটা স্টীমার নদী পারাপার করে। মিলের লোকজনরাই যাতায়াত করে। নদীর ধারে লোহার জালের বেড়া – তার পর গাছের সারি – তারপর রাস্তা কোয়াটার্সের দিক থেকে সোজা মিল অবধি চলে গেছে। সবাই এই পথেই যাতায়াত করে। প্রায় ছয়’শ একর যায়গা নিয়ে এই জুটমিল। আম, জাম, পিপুল, ছাতিম, বকুল, কৃষ্ণচূরা, মেহগনি থেকে আরম্ভ করে কত যে জানা আজানা বিশাল বিশাল মহীরুহ আছে তার ইয়ত্তা নেই।  

গেস্ট হাউসের কেয়ার টেকার আবদুল – বছর ষাটতো হবেই – বেঁটে, শ্যামলা, টাকমাথা, ভাল স্বাস্থ্য। মুখে সাদা দাড়ি, গোঁফ কামান। সাদা ইউনিফর্ম পরা। রান্নাবান্নাও আবদুলই করে। বলতে গেলে আবদুলই এই মিলের সব থেকে পুরানো কর্মচারী। প্রায় তিরিশ বছর ধরে এই মিলেই এই গেস্ট হাউস দেখাশোনা করছে। সামন্ত আমাকে গেস্ট হাউসে পৌঁছিয়ে দিয়ে আবদুলকে সব বুঝিয়ে বাড়ি গেল খেতে। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আসব বলে গেল। আমাদের ড্রাইভার বনোয়ারী  গাড়ি নিয়ে অফিস ফিরে যাবে। ও আগেই মিলে যে ব্যাচেলার মেস আছে তার ডাইনিং রুমে খেয়ে এসেছে। আবদুল টেবিলে খাবার সাজিয়েছে – সাহেবদের আমল থেকে যে সে এই মিলে আছে তা আর বলে দিতে হয় না। ভাত, চাপাটি, ডাল আলুভাজা, পটলের ডালনা, কাৎলা মাছের দুটো বড় পিস, মাংস, শশা, টম্যাটো, আর পেঁয়াজের সালাড, পাপড়ভাজা, দই, রসোগোল্লা চিনেমাটির  বিভিন্ন সাইজের বাওলে সাজান। আমি প্রায় আঁতকে উঠে বললাম – “এত তো আমি খেতে পারবনা”।  

আবদুল বলল – “আপনি যতটা ভাল লাগে খান। আরও গেস্ট আছে – ঐ অডিটবাবুরা আসবেন। আপনি তো এখন আছেন – আপনার যে রকম ভাল লাগে বলবেন আমি করে দেব”। কিছুক্ষণ পরে আরও দুই ভদ্রলোক এলেন। এরাই তা’হলে অডিটবাবু।

খাবার পর ঘরে এসে একটু শুতেই কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। ঘুম ভাঙল প্রায় তিনটে। এই রে সামন্ত বোধ হয় এসে ফিরে গেছে। যা হোক চোখেমুখে জল দিয়ে আমি রেডি হয়ে তো থাকি। গেস্ট হাউসের টেলিফোন বেজে উঠল। আবদুল আমায় এসে বলল – “সামন্ত সাব ডাকছেন”। আমি গিয়ে ফোন ধরতেই সামন্ত বলে উঠল – “আমি সাড়ে তিনটের মধ্যেই চলে আসছি – একটু ঝামেলায় আটকে গিয়েছিলাম”। বুঝলাম সামন্ত আসে নি। আবদুল একটু কফি করে দিল। প্রায় তিনটে পঁয়তিরিশ নাগাদ সামন্ত এল – সঙ্গে বছর তিরিশেক বয়সের একটি ব্যক্তি – মাঝারি লম্বা, একহারা চেহারা, অল্প বয়সেই মাথায় বেশ টাক পড়ে গেছে। সামন্ত ঘরে ঢুকেই বলল –“চলুন স্যার। আচ্ছা এ হ’ল – প্রদীপ কুণ্ডু, আমাদের কোয়ালিটি কন্ট্রোলের সিনিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট। প্রদীপ এ কদিন আপনার সাথেই থাকছে। আপনার ল্যাব টেস্টিং গুলো করে দেবে আর যে ভাবে বলবেন ও অ্যাসিস্ট করবে”। প্রদীপ পাওয়ার অ্যানালাইসারের ইন্সট্রুমেন্টের বড় স্যুটকেসটা নিয়ে নিল। আমি ফাইল ও অন্যান্য ইন্সট্রুমেন্টশুদ্ধ আমার ব্রিফকেসটা নিয়ে নিলাম। গেস্টহাউস থেকে হাঁটতে হাঁটতে পাওয়ার হাউসে এলাম।     

জেনারেটর রুম পেরিয়ে ইলেট্রিকেল ওয়ার্কশপ। তার ভেতরে একটা বড় কিউবিকেল কাঠ আর ওপরের অংশ ঘষা কাঁচের। এটাই ঘোষ সাহেবের অফিস। ঘরে ঢুকে দেখি উনি একটা নোটপ্যাড মন দিয়ে দেখছেন। আমাদের দেখে বললেন – “ও আপনারা এসে গেছেন। চলুন আমরা বরং মিলের ভেতরেই যাই।” সব জুট মিলেই দুটো ভাগ – একটাকে বলে মিল সাইড যেখানে কাঁচা পাট থেকে প্রসেস করে পাটের সুতো বানানো হয়। আর অপরটি হ’ল ফ্যাক্টরী সাইড যেখানে সুতো থেকে চটের কাপড়, বস্তা ও অন্যান্য প্রোডাক্ট তৈরী হয়। আমার কাজ মিল সাইডে – সুতো তৈরীর যে মেশিন সেই স্পিনিং ফ্রেমে যেখানে একবারে একশ ববিন সুতো হয়।

স্পিনিং সেক্সনে আমাদের দেখে সাদা প্যান্ট শার্ট পরা মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে ঘোষ সাহেবকে বললেন “আমি স্যার আপনার কথামতন চারটে স্পিনিং ফ্রেম ঠিক করে রেখেছি। আপনার লোকরা বত্রিশ নম্বরে আছে” – এই বলে আমাদের নিয়ে স্পটে চললেন। যেতে যেতে  আলাপ হল – মিল ম্যানেজার মিঃ ভৌমিক। বত্রিশ নম্বর স্পিনিং ফ্রেমের  কাছে দু’জন মেকানিক আর একজন ইলেক্ট্রিসিয়ান দাঁড়িয়ে আছে। ঘোষ সাহেব আমার পাওয়ার অ্যানালাইসার যন্ত্রটা দেখে বেশ খুসী – এই প্রথম ওনাকে একটু হাসতে দেখলাম। ইলেক্ট্রিসিয়ান মোতিরাম আমার ইন্সট্রুমেন্টটা মেন সুইচ খুলে তিনটে তার তিনটে ফেজের জাংশনে লাগাচ্ছে। ঘোষ সাহেব যন্ত্রটা বেশ মন দিয়ে দেখে বললেন – “আচ্ছা এটা তো দেখছি সব কটা প্যারামিটারই দিচ্ছে উইথ প্রিন্টাউট। আমার মনে পড়ছে আমি তখন জার্মানির বেয়ার্নে একটা টেক্সটাইল মিলে ট্রেনি ছিলাম – তিপ্পান্ন-চুয়ান্ন সালের কথা বলছি। সেখানে ঠিক এরকম যন্ত্র দিয়ে বিভিন্ন মেশিনের ইলেক্ট্রিক্যাল কনসাম্পশন অ্যানালিসিস করা হত। তবে সেটাতো আর এত কমপ্যাক্ট ডিজিটাল ছিল না, অ্যানালগ টাইপের – বিরাট হারমোনিয়ামের মত কাঠের বাক্সে মিটার, সুইচ সব লাগান থাকত। ওকে বলত ‘লাস্ত অ্যানালিসেতোয়ার’ অর্থাৎ লোড অ্যানালাইসর। লাস্ত মানে লোড”। আমি প্রদীপ কুণ্ডু, মোতিরাম আর দু’জন মেকানিকের সাহায্যে আমার এক্সপেরিমেন্টের একটা ট্রায়াল শুরু করলাম।

“পরে কথা বলব” – বলে সামন্ত চলে গেল। ঘোষ সাহেব কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।   

(৪)

সাড়ে ছটা নাগাদ আমি গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম। পরদিন সকাল আটটা থেকে কাজ আরম্ভ করব। গেস্ট হাউসে ঢোকার মুখে সেই বেলজিয়ান লোকটির সাথে দেখা। সেও গেস্ট হাউসে ঢুকছে। বছর তিরিশ-পয়ঁতিরিশ বয়স হবে। লম্বা পাঁচ নয় কি দশ। পেটান চেহারা। খাড়া নাক, ঘন নীল চোখ, মাথায় লালচে বাদামি বা অবার্ন চুল–  মুখে হাল্কা লালচে দাড়িগোঁফ। সাদা টি শার্ট আর ডেনিম ওভারঅল পরা, পায়ে স্নিকার। আমাকে দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে মুখ টিপে এক গাল হেসে – ‘হ্যালোওও’ বলে শিস দিতে দিতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।  

 আমি হাত মুখ ধুয়ে সামনের বারান্দায় একটা গার্ডেন চেয়ারে চুপচাপ বসে আছি – সামনেই গঙ্গা। মিলের ষ্টীমারটা ভুট ভুট করতে করতে ওপারে যাচ্ছে। “আপনার কাজ হ’ল?” – গলা শুনেই বুঝলাম সামন্ত এসেছে। “আসুন” – বলে আমি একটা চেয়ার এগিয়ে দিলাম। আকাশে ঘন মেঘ – মাঝে মাঝেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে। আবদুল কফি আর এগ পাকোড়া বানিয়ে দিয়ে গেল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছে।

আমি বললাম – “ঘোষ সাহেব খুব মেথডিক্যাল। কাজের ব্যাপারে খুব সিরিয়াস”।

– “ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম লোক খুব কমই আছে। শিবপুর থেকে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিলেত চলে যান। জার্মানিতে টেক্সটাইল মিলে কাজ করতেন। ইন্ডিয়াতে ফিরে মুম্বাইয়ের থানেতে রেমন্ডসে চাকরি করতেন। সেখান থেকেই বোধ হ্য় আমাদের বাবু মানে পঙ্কজবাবুর সাথে পরিচয়। বছর দশেক হ’ল পঙ্কজবাবুই ওনাকে এই মিলে চিফ ইঞ্জিনিয়ার করে নিয়ে আসেন। উনি এটা ছাড়া বাবুর আরও দুটো মিল দেখেন”।  

– “তার মানে উনি ঠিক চটকলের সাহেব নন”।

– “একেবারেই নন। চটকলের সাহেব যদি দেখতে চান কালকে আসবেন – দেখিয়ে দেব। এখন কিচ্ছু বলবোনা। আগে কালকে দেখে নিন”।

আমি হেসে বললাম – “ঠিক আছে ব্যাপারটা রহস্যই থাক। আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। এই যে আমাদের ইনস্টিটিউট থেকে জুটের এত ডেভেলপমেন্টসের কাজ হয় আর আমরা ল্যাবোরেটরিতে, এমন কি মিল ট্রায়ালে এসেও ভাল রেসাল্ট পাই, আপনাদের দেখিয়েও দিই অথচ পরে আপনারা বলেন যে তেমন কোন ইমপ্রুভমেন্ট হচ্ছে না। রহস্যটা কি বলুনতো? আমাদের কাউন্সিলের মিটিঙে এসেতো আপানাদের প্রেসিডেন্ট, চিফ এক্সিকিউটিভরা খুব গালভরা কথা বলেন। কিন্তু কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা কেন?”  

সামন্ত কফিতে দুই চুমুক দিয়ে সিগেরেটে ঘনাদার মতন এক লম্বা টান মেরে বলল – “স্কুলের সংস্কৃতের পণ্ডিতমশাই ক্লাসে এসে প্রথমেই রামপদকে শব্দরূপ, ধাতুরূপ ধরতেন। রামপদতো এমনিই পড়াশুনা করতো না – তার ওপর আবার শব্দরূপ-ধাতুরূপ। ফলতঃ যা হ’ত পন্ডিতমশাইও রোজ ওকে দু’তিন ঘা বেতের বাড়ি মেরে সারা ক্লাস দাঁড় করিয়ে রাখতেন। এ ভাবে আর কাঁহাতক পারা যায়। গরমের ছুটিতে রামপদ খুব মন দিয়ে সংস্কৃত পড়ল। ছুটির পর স্কুল খুললে পণ্ডিতমশাই যথারীতি রামপদকে বললেন – “লতা শব্দের রূপ বল্‌”। এবারে রামপদ গড়গড় করে বলে গেল। আগে আগে পণ্ডিতমশাই ওকে ওনার টেবিলের সামনে ডেকে এনে পেটাতেন। এবার নিজে উঠে গেলেন  – বেশ ঘা’কতক বেত মেরে বেঞ্চির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললেন – “হতভাগা, অলপ্পেয়ে মর্কট এতদিন তা’ হলে পারিস নি কেন?”

আমিতো হো হো করে হেসে উঠলাম। সামন্ত বলল – “তা’ আমাদের অবস্থা রামপদর মতন। বাবু বলবেন – এটা তো মিলের করার কথা ছিল – এতদিন হয় নি কেন? মিলের কত লোকসান হয়েছে। সব কো লাথ মারকে ভাগা দো। আমাদের মালিক এ রকম বলে না বটে – মাড়োয়ারী মিলে যান না। বুড়ো মালিক সে প্রেসিডেন্টই হোক আর যেই হোক – মুখের ওপর বলে দেবে – “তুঝকো লাথ মারকে ভাগা দেগা”।

  – “সত্যি?”

– “আমার নিজের কানে শোনা। আসল কথা কি এ সব ডেভেলপমেন্টের কাজ করতে গেলে পয়সা চাই – কিছুতো ইনভেস্ট করতেই হবে। মালিক সেটা করবে না। আরে আপনাদের তৈরী যে ময়েশ্চার মিটার – কত আর দাম – চার পাঁচ হাজার। দুবছর ধরে চেয়েও পাচ্ছি না। অথচ কাজের কত অসুবিধা হচ্ছে। খাতায় কলমে লস দেখিয়ে টাকা চলে যাচ্ছে মালিকেরই অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে। সবই আপনারা জানেন। এ তো নতুন কথা নয়”।

  কথায় কথায় প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেল। সামন্ত “চলি সাহেব” বলে উঠে পড়ল।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম – “আপনি তো এখানে কোয়াটার্সেই থাকেন?”

– “না না আমি থাকি খুব কাছে – জগদ্দলেই। বাড়ি আমার বর্দ্ধমানে – সেহারা বাজার। রিটায়ারের পর ওখানেই ফিরে যাব”।

সামন্ত স্কুটারে চলে গেল। আবদুল ডিনার সার্ভ করে দিল। চিকেন স্যান্ডউইচ, বয়েলড ভেজিটেবলস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর পুডিং। আসলে বেলজিয়ান সাহেবের জন্য বানাচ্ছিল আমি শুনে বলেছিলাম আমাকেও ঐ রকম দিও। খাবার পর কফি নিয়ে বারান্দায় বসলাম। চারিদিক নির্জন, নিস্তদ্ধ অন্ধকার রাত্রি, মিলের ল্যাম্পপোস্টের টিমটিমে আলোগুলোকে ছোট মোমবাতির আলোর মতন লাগছে। একটানা  ঝিঁ ঝিঁ ডেকে চলেছে। মাঝে মাঝে কোথা থেকে চাক্‌ চাক্‌ চকর্‌র্‌র্‌ করে রাতচরা নাইটজার পাখি ডাকছে – সামনে গঙ্গা, দূরে ওপারে ক্ষীণ তারার আলোর মতন আলো দেখা যাচ্ছে। চুপচাপ বসে ভাবছি।

ভারতে ব্রিটিশ জাতির তিনটি কৃষি শিল্পের অবদান – নীল, পাট আর চা। অধিক মুনাফার লোভ, কৃত্তিম নীলের আবিষ্কার আর নীল বিদ্রোহের ফলে নীলের চাষ একদিন বন্ধ হয়ে গেল। এখানে ওখানে কয়েকটা ভাঙা নীলকুঠি গরীব চাষীদের ওপর নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পাট’তো এখন অস্তগামী-সূর্য শিল্প। চা বাগানগুলোওতো ধুঁকছে। অথচ এই চা আর পাট ছিল পশ্চিম বঙ্গের প্রধান অর্থনৈতিক উৎস। পাটের চাষ হ’ত প্রধানত পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ এখনকার বাংলাদেশে। যেমন তার সোনালী রঙ তেমনই সিল্কের মতন মসৃন। সেই পাট থেকে হাতে করে সুতো বানিয়ে চটের কাপড় পর্য্যন্ত তৈরী হত। দেশে ও বিদেশের বাজারে বেশ চাহিদা ছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা পাটের গাঠঠি চালান দিতে আরম্ভ করল ইংল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে গড়ে উঠেছিল একের পর এক জুটমিল। বিশ্বজোড়া বাজারে মুনাফা লুঠছিল ভালই। স্কটিশরা চিরকালই বানিয়ার জাত। যেখানে পাট চাষ হচ্ছে সেখানেই যদি জুটমিল হয় তবে তো উৎপাদন খরচা অনেক কমে যাবে।

১৮৫৪-৫৫ সাল নাগাদ স্কটল্যান্ডের জর্জ অকল্যান্ড ডান্ডি থেকে যন্ত্রপাতি এনে শ্রীরামপুরের কাছে রিষরায় জনৈক বাঙালি বৈশম্ভর সেনের আর্থিক সহায়তায় ভারতে প্রথম ‘রিষড়া টোয়াইন এন্ড ইয়ার্ন মিল’ নামে এক চটকল স্থাপন করল। বছর তেরো চলার পর মিল বন্ধ হয়ে যায়। পরে অবশ্য নতুন করে প্রথম ক্যালকাটা জুট মিল কোম্পানি ও পরে ওয়েলিংটন জুট মিল নাম নিয়ে খোলে। এর পর থেকে দক্ষিণে নূরপুর-ফলতা থেকে শুরু করে উত্তরে ব্যান্ডেল পর্য্যন্ত হুগলি নদীর দুই তীর ধরে ইংরেজ আমলে গড়ে উঠেছিল যত চটকল। উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই এই চটশিল্পের জয়যাত্রার শুরু।    

১৮৬৩-তে স্কটল্যান্ড থেকে সেদিনের ইংরেজ শাসিত ভারতের রাজধানী কলকাতায় এসে কোম্পানি পত্তন করেছিলেন যুবক ইংরেজ অ্যান্ড্রু ইউল, ওয়াল্টার ডানকান। অ্যান্ড্রু ইউল কোম্পানি, জার্ডিন-স্কিনার, ডানকান ব্রাদার্স, থমাস ডাফ কোম্পানি, আর ক্যাপ্টেন সাম বার্ডের প্রতিষ্ঠিত বার্ড কোম্পানির পরিচালনাতেইতো ছিল প্রায় গোটা পঁচিশ-তিরিশটারও বেশী চটকল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ছিল প্রায় আটতিরিশটা চটকল – সেখানে ইংরেজ যখন ভারত ছেড়ে যায় তখন চটকলের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে একশ এগারোয়। দু- দুটো বিশ্বযুদ্ধের বাজারে চটের চাহিদা হু হু করে বেড়ে যাওয়ার ফল।  

কাঁচা পাটের সিংহভাগ উৎপন্ন হ’ত পূর্ব্ব বাংলায় আর যত চটকলগুলো ছিল পশ্চিমবঙ্গে। ভারত স্বাধীন হ’ল – ইংরেজরা দেশ ছেড়ে চলে গেল। যাবার সময় দেশ ভাগের সাথে সাথে রমরমা পাটশিল্পটাকেও এমনভাবে কেটে দু’টুকরো করে দিয়ে গেল যে আর যাতে মাথা তুলতে না পারে।

বর্তমানে গোটা পঞ্চাশেক জুটমিল চলছে – তাও আজ এটা খোলে তো কাল ওটা লক আউট হয়ে যায় মাস দু’তিনেকের জন্য। ঐ জুট ডেভেলপমেন্ট প্যাকেজ, স্পেশাল ফান্ড, ম্যান্ডেটরি জুট ব্যাগের ব্যবহার এসব করে আর কত দিন চলবে? স্কটল্যান্ডের ডান্ডির জুট মিলগুলো কবে সব বন্ধ হয়ে গেছে – দু’একটা আছে – ঐ সুতো বানায়। আমাদের এখানেও আর কতদিন? আর জোর বছর পঞ্চাশেক। নেহাৎ বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের বেশ বহু লক্ষ  কৃষি-শ্রমিক-মধ্যবিত্ত পরিবার এই পাটশিল্পের ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে তাই একে কোনমতে টিঁকিয়ে রাখা হচ্ছে।

আর জুটমিলের এ হেন হাল হবে নাই বা কেন? সেই একশ-দেড়শ বছর আগেকার সব মেশিনারি, সেই আদ্যিকালের মান্ধাতার আমলের পুরান চিন্তাধারা, কর্মসংস্কৃতি, পরিচালনা পদ্ধতি, রক্ষণশীল আর সামন্ততান্ত্রিক মনোভাব। মালিক বদলেছে, ম্যানেজাররা বদলেছে – বদলায়নি চ ট ক ল। অটোমেশনের কোন প্রশ্নই নেই – একান্তভাবে কায়িক শ্রম নির্ভর শিল্প। বাজার দর বেড়েছে – শ্রমিক-কর্মচারীদের মাইনে বেড়েছে, কাঁচা মালের দাম বেড়েছে, অন্যান্য আনুসঙ্গিক সব কিছুরই দাম বেড়েছে। আবার উল্টোদিকে জুটের বাজার ক্রমশঃ নিম্নমুখী। সিন্থেটিক মানে পলিয়েস্টার, পলিপ্রপিলিন এদের দাপটে জুটের নাভিঃশ্বাস উঠছে। একটা একটা করে জুটমিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।  

চমক ভাঙল আবদুলের কথায়। ও বাড়ি যাচ্ছে। মিলের ভেতরেই পেছন দিকে কোথাও থাকে। পুরো নীচের তলাটায় আমি একা। আমার অবশ্য একা থাকতে খারাপ লাগে না। নানা রকম সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সময় কেটে যায়। প্রায় সাড়ে দশটা বাজে। কি রকম ঝিমুনি আসছে – নাঃ শুয়েই পরা যাক।

(৫)

রান্নাঘরের টুং টাং শব্দে বুঝলাম আবদুল এসে গেছে। চা খেয়ে স্নানটান সেরে, ব্রেকফাস্ট করে আটটা নাগাদ – মিলে চলে এলাম। মোতিরাম আর মেকানিক দুজন হাজির। প্রদীপ কুণ্ডুও মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চলে এল। আমরা কাজ আরম্ভ করে দিলাম। কাজ আমার পরিকল্পনা মতন ভালই হচ্ছে। মাঝে একবার মিনিট দশেকের মতন কোয়ালিটি কন্ট্রোলে গিয়ে চা খেয়ে এলাম। সওয়া এগারোটা নাগাদ মিলে রাউন্ডে এসে মিঃ সোমানি এলেন আমার কাছে। বেশ ইন্টারেস্ট নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে দেখে আবার রাউন্ডে গেলেন। দেখলাম একটু দূরে মিল ম্যানেজার মিঃ ভৌমিকের সাথে কথা বলছেন।

খানিক বাদেই মিঃ ভৌমিক আমার কাছে এক গাল হেসে বললেন – “কোন অসুবিধা হলে কিন্তু বলবেন”। কাজ এগোচ্ছে – অনেক কৌতূহলি শ্রমিক মাঝে মাঝে ভীড় করে দেখার চেষ্টা করছে যে ব্যাপারটা কি হচ্ছে। আবার সর্দারের তাড়া খেয়ে চলে যাচ্ছে। আমার পাওয়ার অ্যানালাইসারের থেকে তিনটে লাল, নীল হলুদ তার মেইন সুইচে গেছে আবার তিনটে ঐ রঙের কেবল প্রোব তিনটে মেইন তারে আঙটার মতন লাগান। হঠাৎ কানে এল দুই উৎসুক জনতার কথা একজন আরেকজনকে জিজ্ঞাসা করছে –“ইয়ে কেয়া হোতা হ্যাঁয়?” আমি পেছন ফিরে তাকালাম। অপর লোকটি অল্পবয়সি, গম্ভীর ভাবে জবাব দিল – “ফ্রেমকা ই সি জি”।

কাজ চলছে – প্রায় বারোটা বাজে। স্পিনিং-এর লাইন ধরে এক ভদ্রলোক আসছেন। লম্বা ছ’ ফিটের কাছাকাছি, ফর্সা, মাথায় চক চক করছে টাক, এ কান থেকে ও কান মাথার পেছনে চুল, চোখে মোটা বাদামি ফ্রেমের চশমা। বয়স আশির ওপরেতো বটেই। এককালে ভালই চেহারা ছিল এখন বয়সের ভারে শুস্কং কাষ্ঠং হয়ে গেছে – নিখুঁত ভাবে দাড়িগোঁফ কামানোতে ভাঙা গাল চকচক করছে। মুখের মধ্যে একটা খেকুড়ে ভাব। কাল প্যান্ট, হাল্কা নীল স্ট্রাইপ দেওয়া ফুল শার্ট – লাল বেনারসির কলখা ডিসাইনের চওড়া টাই। লম্বা লম্বা পা ফেলে একটু ঝুঁকে ঝুঁকে স্পিনিং-এর লাইন ধরে এদিক ওদিক দেখতে দেখতে আসছেন। মাঝে মাঝে কোন কোন ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে দেখছেন। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল – এই নিশ্চয়ই সামন্ত উল্লিখিত আদর্শ চটকলের সাহেব। কারণ এরকম দু এক পিস স্যাম্পল আমি আমাদের ইনস্টিটিউটের সেমিনারে আসতে দেখেছি। সামনের সারিতে বসবে আর সব লেকচারে ফোঁড়ন কাটবে। প্রশ্নটা অতি সাধারণ – কিন্তু তার আগে নিজেই পাঁচ সাত মিনিট মাথামুন্ডুহীন এক লেকচার দিয়ে দেবে।  

একটা নাগাদ গেস্ট হাউসে এসে খেয়ে নিয়ে আবার দুটোর মধ্যে কাজ আরম্ভ করে দিলাম। সাড়ে ছ’টার মধ্যে আজকের মত কাজ শেষ। একটা ফ্রেম শেষ করে দ্বিতীয় ফ্রেমে ইনস্ট্রুমেন্ট লাগিয়ে রেখে এলাম। গেস্ট হাউসে ঢুকতেই আবার দেখা ঐ বেলজিয়ান সাহেবের সাথে। নিজেই এগিয়ে এসে ‘হ্যালোওও’ বলে এবার আমার সাথে হ্যান্ডশেক করল। আমিও ভদ্রতার খাতিরে আমার ঘরের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে “হ্যাভ সাম কফি” বললাম। ও একটু কাঁধ ঝাঁকিয়ে “ওখে – জাস্ট ফাইভ মিনিতস” বলে ওপরে চলে গেল। আমি হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসলাম – কিছুক্ষণ বাদে সাহেব এল। আবদুল কফি আর পটাটো চিপস রেখে গেল। খেতে খেতে গল্প হচ্ছে। রাত আটটা নাগাদ আবদুল এখানেই ডিনার টেবিলে খাবার দিয়ে গেল।      

আমি ভুল ভেবেছিলাম – সাহেব আদৌ বেলজিয়ান নয়। নাম অ্যালান ডেভিস। জাতে ইংরেজ – স্কটিশ। তবে হাইল্যান্ডার গোরা নয়। আদত দেশ স্কটল্যান্ডের আবেরদীন – উত্তর সাগরের তীরে এক বন্দর শহর। ওর দাদুর বাবা ভাগ্যান্বেষণে চলে যায় দক্ষিন আফ্রিকা, প্রিটোরিয়ার এক খনিতে কাজ করত। দাদুর এক কাকা থাকতো গ্লাসগোতে। তাদের বংশধররা এদিক ওদিক সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কচিৎ দেখা সাক্ষাৎও হয়। দাদুর আর এক কাকা বোধ হয় ডান্ডিতে কোন জুটমিলে কাজ করত। ঠিক নিশ্চিত নয় তবে শুনেছিল সে নাকি ইন্ডিয়াতে চলে আসে। পরে তার বা তার বংশধরদের আর কোন খবর কেউ কোনদিন পায় নি। অ্যালানের দাদু দক্ষিণ আফ্রিকা ছেড়ে চলে আসে রোডেশিয়া অর্থাৎ এখনকার জিম্বাবোয়েতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবা রয়্যাল এয়ার ফোর্সে ছিল। পরে ডেনমার্ক চলে যায়। কাকারা কেউ ইংল্যান্ডে কেউ জার্মানিতে সেটল করে গেছে। অ্যালান ডেনমার্ক টেকনিক্যাল ইউনিভারসিটিতে পড়াশোনা করেছে। এখন থাকে বেলজিয়ামের মার্কে। ওর এক দিদি আছে কানাডায় আর এক দিদি অস্ট্রেলিয়ায়।     

একসাথে খাওয়া দাওয়ার পর নটা নাগাদ অ্যালান গুড নাইট বলে বিদায় নিল। কাল বুধবার দুপুরে ও কলকাতা যাবে। পরদিন সকালে ফ্লাইট ধরে দিল্লি যাবে। সেখানে কদিন কাটিয়ে যাবে লুধিয়ানা। তারপর চীন, সাউথ কোরিয়া হয়ে বেলজিয়াম ফিরে যাবে। সারা দুনিয়াই কার্পেট লুম ইনস্টল করতে ঘুরে বেড়াতে হয়।

আমি আবার ফিরে বারান্দায় চেয়ারে এসে বসলাম। আবদুলকে কফি দিতে বললাম। খানিক বাদে আবদুল কফি নিয়ে এল। চুপচাপ বারান্দায় বসে আছি। বাইরে টিপ টিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হ’ল। সাথে বেশ হাওয়াও আছে। গায়ে জলের ছাট এসে লাগছে। ঘরে চলে এলাম। আবদুল চলে গেল। সারাদিন বেশ ধকল গেছে। ক্লান্ত লাগছে।

(৬)  

আজ বুধবার – ২৬শে সেপ্টেম্বর। আমার কাজটা ভালই এগোচ্ছে। প্রদীপ, মতিরাম ও মেকানিক দুজনও ব্যাপারটা বুঝে গেছে। ফলে কাজের গতিটাও বেড়ে গেছে। এগারোটার মধ্যে দ্বিতীয় ফ্রেমের কাজ শেষ। আধা ঘন্টার জন্য আমি আর প্রদীপ কোয়ালিটি কন্ট্রোলে এলাম চা খেতে। মোতিরামরাও চা খেতে গেল। ল্যাবে ঢুকতেই সামন্ত বলে উঠল – “আসুন আসুন, আর স্যার কাল সারাদিন আপনার সাথে দেখাই করতে পারিনি। যা ঝামেলা গেল”।

আমি বললাম – “আপনার দেবতা তুষ্ট হলেন?”

সামন্ত একটু তাচ্ছিল্যের সাথে বলল – “হ্যাঁ, হ্যাঁ। এরা…ওই বটগাছের তলার ছোটখাটো শিবলিঙ্গ। একটু জল, বেলপাতা আর কলা-বাতাসায় হয়ে যায়”।

ওনার বলার ধরণে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। এর মধ্যে চা এসে গেল। চা খেয়ে আমি মিলে একাই ফিরে এলাম। প্রদীপ আজ ল্যাবোরেটরির টেস্টিং-এর কাজগুলো করবে। সামন্ত সন্ধ্যেবেলা গেস্টহাউসে আসবে জানাল। লাঞ্চের সময় প্রায় দেড়টা নাগাদ গেস্ট হাউসে এলাম। সিঁড়ির সামনের রাস্তায় গাড়ি দাঁড়ান। অ্যালানের দুটো ঢাউস সুটকেস ডিকিতে তোলা হচ্ছে। ওর পিঠে একটা মাঝারি সাইসের রুক স্যাক। অ্যালান আমাকে দেখে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল। এখানকার কাজ শেষ। আমিও ওর যাওয়া অবধি দাঁড়িয়ে রইলাম। গাড়ি স্টার্ট নিল – ওকে বাই বাই জানিয়ে খেতে এলাম।

ছটা নাগাদ কাজ শেষ করে গেস্ট হাউসে ফিরলাম। বেশ ভাল রকম বৃষ্টি হয়ে গেছে। মিলেই অবশ্য টের পাচ্ছিলাম। হাতমুখ ধুয়ে কফি নিয়ে বারান্দায় বসলাম। একটানা ঝি ঝি ডাকছে। দূর থেকে মিলের ছ’শ তাঁত চলার শব্দ ভেসে আসছে। সামন্ত এলো সোয়া সাতটা নাগাদ।  কফি, বেগুনি, পেঁয়াজি আর সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বারান্দাতেই বসা হ’ল। খেতে খেতে আমি জিজ্ঞাসা করলাম – “আচ্ছা কাল এক লাল টাই পরা বুড়োকে দেখলাম – ওই কি আপনার সেই চটকলের সাহেব?”  

সামন্ত কফিতে চুমুক দিতে দিতে চোখ তুলে আমার দিকে চেয়ে একটু মিচকি হেসে শুধু ভুরু নাচাল।

আমি বললাম – “তা ইনি কে বটেক?”       

 – “ইনি স্বনামধন্য রন্টি মিটার। আসল নাম রণতোষ মিত্র – পার্ক সার্কাস না পাইকপাড়ার নামজাদা মিত্রবাড়ির ছেলে।  কোন এক সাহেবি স্কুল থেকে হোঁচট খেতে খেতে স্কুলের গন্ডি কোনোমতে টপকে বাপের পয়সায় বিলেত যাত্রা। সেখানে ডান্ডিতে জুটের ওপর কি সব সারটিফিকেট কোর্স টোর্স করে ওখানকার এক চট কলে  কাজ করতেন – কাজ মানে ওই মেশিন চালান গোছের। বছর কয়েক কাটিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগতেই দেশে ফিরে আসেন। ওখানকার মিলের  ম্যানেজারের একটা চিঠি নিয়ে এখানে জার্ডিন স্কিনার কোম্পানির এক চটকলে জুনিয়ার সুপারভাইসার হয়ে জয়েন করেন।        

সেই প্রথম চটকল প্রতিষ্ঠা থেকে সুরু করে এই প্রায় ১৯৩৫-৪০ সাল অবধি চটকলে সেই ম্যানেজার থেকে আরম্ভ করে সুপারভাইসিং স্টাফ, অফিস স্টাফ, ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক, স্টোর ক্লার্ক  প্রায় সবই ছিল সাহেবসুবোরা আর ভারতীয় বলতে শুধু বিহার উত্তর প্রদেশ থেকে আসা কুলি মজুর – কল চালান শ্রমিক শ্রেণী । শুধু এই চটকলগুলোই নয় – তখন যত ইংরেজদের ফার্ম ছিল চা, জুট, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যাঙ্ক, ইন্সিওরেন্স সবেতেই প্রাধান্য বেশী ছিল স্কটিশদের আর ভারতীয়রা ছিল বেয়ারা, বাবুর্চ্চি, দারোয়ান চাকর-বাকর, ক্বচিৎ কোন কোন ফার্মে কেরানি বা অ্যাকাউনটেন্ট। এদের ঠিক ওপরে তদারকির জন্য ছিল অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানরা। পরে পরে অবশ্য কিছু বাঙালি ছেলে বিশেষতঃ বিলেত-ফেরৎ, ধনী নামকরা বৃটিশ-ভক্ত পরিবারের সন্তান এইসব সাহেব কোম্পানিতে ঢুকতে শুরু করল – চা বাগানে, চটকলে কুলি-মজুরদের ঠ্যাঙানোর কাজে। তা’ আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রিতে এ রকম কয়েকটা স্যাম্পল এখনো দেখা যায়। 

সেই একটা কথা আছে না – ‘চলে গেছে গিন্নি – রেখে গেছে চিহ্ণি’। ভারত স্বাধীন হবার সাথে সাথে অধিকাংশ বৃটিশ, স্কটিশরা তো এ দেশ ছেড়ে চলে গেল। ফলে সাহেব কোম্পানিগুলোর মাঝেরতলা, ওপরতলা সব ফাঁকা। হাঁড়িখাকির এই বেলা। তখন এই সব রন্টি মিটার, স্যান্টি বোস – এরা ওই জুনিয়ার সুপারভাইসার থেকে একেবারে হাইজাম্প মেরে অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার – আর তার কয়েক বছর পর এই সত্তরের দশকের দিকে যখন সাহেবদের জমানা শেষ তখন সব   চিফ এক্সিকিউটিভ, প্রেসিডেন্টের পদ অলঙ্কৃত করলেন। সাহেবদের কাছে থেকে শিখেছিলেন চার আনা টেকনোলজি, চার আনা সাহেবি কেতা আর আট আনা মদ খাওয়া। তাই দিয়ে সব মাড়োয়ারি, সিন্ধি মালিকদের কাঁচা পাট থেকে আরম্ভ করে এক্সপোর্ট পর্য্যন্ত সর্ব্বস্তরে কিভাবে বাঁকা পথে পয়সা লোটা যায় তা’তে সাহায্য করে আর তার সাথে নিজের ভাগের ভাগ নিয়ে যত সব বেঙ্গল ক্লাব, স্যাটারডে ক্লাব, ক্যালকাটা ক্লাব দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন।  

সাহেবরা ছিল সে আপনার কথায় ডান্ডালজিস্ট – হাতে মারত – গালাগালি দিয়ে, বুটের লাথি, বেতের বাড়ি মারত – কারোর কিছু বলার ছিল না – তারা ছিল শাসকদলের জাত। দিশি সাহেবদেরতো সেটা সম্ভবপর ছিল না – স্বাধীন দেশ – ট্রেড ইউনিয়নের দাপট – হাড়গোড় ভেঙে চুর চুর করে বয়লারে ঢুকিয়ে দেবে। তাই তারা মারতে আরম্ভ করল ভাতে। পাওনা-গণ্ডা না দিয়ে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা মেরে, অবস্থা বুঝে আগুন লাগিয়ে, মিল লকআউট করিয়ে, শ্রমিক ছাটাই করে ডান্ডালজি বহাল রাখল”। এই করে করে কত চটকল যে বন্ধ হয়ে গেল সে তো আপনি জানেন। এই ভাবে ষাট পঁয়ষট্টি বছর চাকরি করে এখন মালিকদের ছেলেদের আমলে যত সব টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসার, কনসালটেন্ট হয়ে সুট-কোট পরে মাঝে মাঝে আসেন, আর মালিকরা যা বখশিশ দেয় তাতে সূর্যাস্ত হলে জলপথে বিচরণ করতে থাকেন। এদের বেশীর ভাগই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়েতে চলে গেছেন – এই গোটা দু’তিনেক বাহাদুর শাহ এখনও রয়ে আছেন”।

আমি বললাম – “আমি আগে সেমিনারে এরকম এক পিস দেখেছি – এদের বায়োডাটা সম্বন্ধে ধারণা ছিল না। আচ্ছা আপনি কোন সাহেবকে বোধ হয় দেখেন নি না?”  

– “ হ্যাঁ, দেখেছি। আমি প্রথম চটকলে ঢুকি চৌষট্টিতে জার্ডিন-স্কিনারের কামারহাটি কোম্পানিতে কোয়ালিটি কন্ট্রোলে জুনিয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট হয়ে, আমার ম্যানেজার ছিল স্ট্যানলি লিকফোল্ড বলে এক স্কটিশ সাহেব – সাতষট্টিতে দেশে ফিরে যায়। তা প্রায় ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। স্বাধীনতার পরও আরও পনেরো-কুড়ি বছর চটকলে, চা বাগানে, সাহেবদের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলোতে মধ্য থেকে উচ্চতম পদে সাহেবরাই বেশি ছিল। আসলে যারা আগে ওই জুনিয়ার সুপারভাইজার, স্টোর ক্লার্ক হয়ে ঢুকেছিল তারাই তখন ম্যানেজার, প্রেসিডেন্ট, জেনারেল ম্যানেজার। তবে নতুন করে আর সাহেব জয়েন করে নি। তখন ভারতীয়রা বাঙালি-অবাঙালি সব ঢুকতে শুরু করেছে। তবে চেনাশোনা থাকলেতো আর কথাই ছিল না। এক কথায় চাকরি। আমার চাকরিওতো আমার মামার সুপারিশে। সত্তরের পর আর কোন চটকলে সাদা চামড়া ছিল না। তখন ট্রেড ইউনিয়নের দাদাগিরি আরম্ভ হয়ে গেছে। বিদেশের বাজারেও জুট প্যাকেজিং-এর চাহিদা সিন্থেটিক প্যাকেজিং-এর  গুঁতোয় কমতে শুরু করে দিয়েছে। আন্ড্রু ইউল, থমাস ডাফ, বার্ড কোম্পানি, ম্যাকলিয়ড সব সাহেবি কোম্পানিগুলো চটকল বেচে দিতে আরম্ভ করল আর কিনল যত কাঁচা পাটের সাপ্লায়াররা। চটশিল্পের স্বর্ণযুগের অবসান – এখনতো অস্তগামি শিল্প।

আমি বললাম – “একটা গল্প বলি শুনুন। অনেকদিন আগে স্টেটসম্যান পত্রিকাতে এক ভদ্রলোকের একটা চমৎকার লেখা পরেছিলাম। সত্যিমিথ্যে জানি না। ঘটনাটা হচ্ছে এক ভদ্রলোক দীর্ঘদিন কোন এক জুটিমিলের হেড অফিসে ওই কেরানীর চাকরি করতেন। শেষ জীবনে হয়তো হেডক্লার্ক অবধি হয়েছিলেন। ওনার ছেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংলিশে এম এ পাস করেছে। অনেক চেষ্টা চরিত্র করেও কোন চাকরি জুটল না। তা’ বাবা একদিন রাত্রিবেলা বললেন – “কাল দশটার সময়ে স্নান খাওয়া-দাওয়া করে আমার সাথে বেরোবি”।

ভদ্রলোক পরদিন ছেলেকে নিয়ে সোজা এলেন ক্লাইভ স্ট্রীটে ওনার আগের জুট কোম্পানির অফিসে। বেয়ারা পিওন থেকে আরম্ভ করে সবাই ওনাকে চেনেন। সটান বড় সাহেবের ঘরে। সাহেব দেখে – “হ্যালো, বাবু হাউ আর ইউ – ইস ইট ইওর সন?” – বলে বসতে বললেন। ভদ্রলোক বললেন –“ ইয়েস স্যার – মাই সান স্যার – এম এম পাশ স্যার। প্রে ফর হিস সারভিস স্যার”। ছেলেতো বাবার ইংরেজি শুনে লজ্জ্বায় মাথা নীচু করে বসে আছে। বড় সাহেব ‘ওখে’ বলে বেল বাজিয়ে খাস পিওনকে ডেকে বললেন – ‘ব্রুস সাহাব কো বুলাও’। খানিক বাদে মাঝ বয়সি এক সাহেব ঢুকতেই বড় সাহেব বললেন – “ব্রুস – হি ইস আওয়ার বাবুস সন – ফ্রম ঠুডে হি উইল অ্যাসিস্ট ইউ”। ব্রুস সাহেবতো ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেলেন। ভদ্রলোক আরও কিছুক্ষণ অফিসে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে বাড়ি ফিরে গেলেন। রাতের বেলা ছেলে বাবাকে বলছে – “আচ্ছা তুমি কি? এতদিন চাকরি করে ইংরেজিটুকুও শিখলেনা। ও রকম ‘ইয়েস স্যার – মাই সান স্যার’ কেউ বলে?” ভদ্রলোক ছেলেকে জবাব দিলেন – “দেখো বাবা ওই ‘ইয়েস স্যার – মাই সান স্যার’ বলে আমি আজ তোমার জন্য যা অতি সহজে করতে পারলাম তুমি ভবিষ্যতে সেক্সপীয়র, শেলী, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ আউরেও তোমার ছেলের জন্য তা’ করতে পারবে না”।     

সামন্ত হাততালি দিয়ে উঠে বলল –“মুজতবা আলির গল্পের মতন বলতে হয় – এমন উমদা কিসসা খুব কম শুনেছি – হক কথা। এখনও আকছার হয় যদি মালিকের খুব জানপহেচান হয়ে থাকে – কোয়ালিফিকেশন লাগে না। বেশীর ভাগ মাড়োয়ারি চটকলে ম্যানেজার, প্রেসিডেন্ট সবই ওই মালিকের মামার মাসতুতো শালা নয়তো পিসের খুড়তোত ভাই।”   

আমি বললাম – “ঠিকই বলেছেন আমি এক জুটমিলের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারকে জানি – ডিগ্রি হচ্ছে বি কম। মালিকের বাড়ির পুরোহিতের ছেলে। সে নিজে আমাকে বলেছে। অবশ্য এতদিন থেকে থেকে কাজ যা শিখেছে কোন পাশ করা ইঞ্জিনিয়ারের থেকে কম নয়”। 

আবদুল আমাকে দুদিনেই চিনে নিয়েছে। তাই দেখলাম কিছু বলার আগেই দু কাপ কফি রেখে গেল। কফিতে চুমুক দিয়ে একটা সিগেরেট ধরিয়ে বললাম –  “আমি এর আগে কিছু কিছু জুটমিলে লন টেনিসের কোর্ট, তারপর ক্লাব হাউসে স্নুকার বোর্ড এসব দেখেছি…”।  

– “আমাদেরও আছে মানে ছিল। এখানে একটা সুইমিং পুলও ছিল। সাহেবদের আমলে সে সব তারাই শুধু খেলতো। তখনতো চাকরবাকর, দারোয়ান মালি ছাড়া নেটিভদের কাউকে এই রেসিডেন্স এলাকাতে ঢুকতেই দেওয়া হ’ত না। সাহেবরা চলে যাবার পর দিশি সাহেবরা সবাই কতটা খেলতো জানি না – তবে ক্লাবে পার্টি, খানাপিনাটা খুব হ’ত।  পঞ্চাশ-ষাটের দশক – তখন স্বাধীন ভারত, দেশীয় কর্মচারীদের পাল্লা অনেক ভারী। তাই অবস্থা বুঝে সাহেবরাও ভাল মানুষ হয়ে গেছে। এক সাথেই সবাই খেলাধুলো আর পার্টিতে হৈ হল্লা করত। আর এখনতো ও সব টেনিস কোর্ট আর সুইমিং পুল কোথায় ছিল জানতে হ’লে মিলের লে আউট দেখতে হবে। ওই ক্লাব হাউসটা শুধু আছে। হলে বিশ্বকর্মা পূজো হয়। দু’একবার কিছু কালচারাল প্রোগ্রাম করা হয়েছিল। আর আপনাদের বা জুট টেকনোলজি ইন্সটিটিউটের ট্রেনিং প্রোগ্রাম-টোগ্রাম থাকলে ওখানে অর্গানাইস করি। ঐ স্নুকার বোর্ডগুলোই শুধু পুরান ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে পড়ে আছে”।  

আমি বললাম – “আচ্ছা জানেন – রাত্রিবেলা যখন এই বিশাল বাড়িতে একা শুয়ে থাকি তখন মনে হয়, আমি যদি ধরুন একশ বছর আগে এখানে আসতাম তা’ হলে এখানকার ছবিটা কি রকম দেখতাম। এই সব বাড়ি ঘর দেখলে আমার কি রকম ক্ষুধিত পাষাণের মতন মনে হয়। মেহের আলির মতন বলতে ইচ্ছে করে – “তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, সব জুট হ্যাঁয়, সব জুট হ্যাঁয়”।  

সামন্ত হো হো করে হেসে উঠল – “দারুন বলেছেন… সব জুট হ্যাঁয়, সব জুট হ্যাঁয়। এই সব চটকলগুলোর ক্ষুধিত পাষাণ হতে আর বেশী দেরী নেই। তবে আপনি যদি সেদিনের ছবির একটু আভাষ পেতে চান – কাল শোনাব। আজ প্রায় ন’টা বাজে – চলি”।

(৭ )

দেখতে দেখতে বৃহষ্পতিবার এসে গেল। আজ আমার কাজটা শেষ হয়ে যাবে। সারাটা দিন পুরোদমে কাজ চলল। মাঝে শুধু একবার গেস্ট হাউসে খেতে এসেছিলাম। মিলের অফিস থেকে আমার ইনস্টিটিউটে ফোন করে জানিয়ে দিলাম গাড়ি পাঠিয়ে দেবার জন্য। কাছেই এক মিলে শুক্রবার দুজন আসবে – ফেরার সময়ে তাদের সাথেই একসাথে ফিরে যাব। মিঃ সোমানি, ঘোষ সাহেব দুজনেই মাঝে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখলেন – কাজ নিয়েও আলোচনা করলেন। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে কাজ সব শেষ। খুব নিশ্চিন্ত লাগছে – সত্যি বলতে এতটা আমি আশা করিনি। প্রদীপ কুন্ডু কোয়ালিটি কন্ট্রোলে টেস্টিং-এর কাজগুলো করছে। কাল সকালেই আমাকে রেসাল্টগুলো দিয়ে দেবে। ছটা নাগাদ ইন্সট্রুমেন্টগুলো সব নিয়ে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম।

আজ সারা দিন আকাশে ঘন মেঘ। বিকেলের দিকে বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। সামন্ত সাড়ে ছটার মধ্যেই চলে এল। আবদুল প্লেটে দুটো করে ডেভিল আর কফি রেখে গেল। খেতে খেতেই গল্প হচ্ছে। আমি বললাম – “আপনি কাল পুরোনো দিনের কথা কি বলবেন বলছিলেন?”

সামন্ত বলল – “আমি যখন কামারহাটিতে ঢুকলাম – ওই ব্যাচেলরদের মেসে না থেকে মিলের খুব কাছে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম। আমার ঠিক পাশের বাড়িতে থাকতেন এক খুব বৃদ্ধ ভদ্রলোক – ভূদেব নারায়ন মল্লিক। বয়স প্রায় নব্বই ছুঁই ছুঁই। কিন্তু তখনও যথেষ্ট সমর্থ। রোজ সকালবেলা সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে হাঁটতেন। দেখেই বোঝা যায় বেশ নিয়মনিষ্ঠ জীবন। ডাফ কলেজ অর্থাৎ বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন। তখনকার প্রিন্সিপাল রেভারেন্ড জন হেক্টর সাহেবের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে পড়াতেন। ভূদেববাবু আমাকে নিজের নাতির মতনই খুব স্নেহ করতেন – পুরানোদিনের অনেক গল্প বলতেন। আমারও শুনতে খুব ভাল লাগতো। ওনার স্কুলের কাছেই ছিল ম্যাকিন্নন ম্যাকেঞ্জি গ্রুপের ইণ্ডিয়া জুট মিল। ওই ম্যাকিন্নন গ্রুপের এক ডিরেক্টর ছিলেন রবার্টসন সাহেব। মিল কম্পাউন্ডে ওনার এক বাংলো ছিল। মাঝে মাঝেই এসে থাকতেন। সেটা ১৯০৩-০৪ সালের কথা।  

সেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন না ছোট ইংরেজ আর বড় ইংরেজ! রবার্টসন সাহেব ছিলেন কিছুটা বড় ইংরেজ – এই স্কটিশ জুটওয়ালাদের মতন ছোট ইংরেজ নন। শিক্ষিত, ব্যারিস্টার ছিলেন – বিলেত থেকেই কোম্পানির ভাল চাকরি নিয়ে এদেশে আসেন। ওনার ইচ্ছে ছিল বাংলা ভাষা শিখে বাংলা বই পড়বেন আর সেরকম ভাল লাগলে কিছু বই ইংরেজিতে অনুবাদ করবেন। রেভারেন্ড হেক্টরের অনুরোধে ভুদেববাবু ওনাকে শনি-রবিবার ওনার বাংলোয় গিয়ে বাংলা পড়াতেন। বয়সে অনেক ছোট হলেও রবার্টসন ভূদেববাবুকে শিক্ষকের মতই শ্রদ্ধা করতেন। আর তার ফলে আর যে সব ছোট ইংরেজরা ছিল তারা ওনাকে ঘাটাততো না’ই বরং একটু এড়িয়ে চলত। আসলে চটকলে, চা বাগানে এই সামাজিক শ্রেণী সচেতনটা খুব প্রবল। ওপরতলার লেভেলের সাহেবদের পার্টি-খানাপিনা হলে নীচের লেভেলের সাহেবরা ব্রাত্য। ওপরওয়ালা যেটাই বলবে মাথা নীচু করে তার একটাই উত্তর – ‘ইয়েস স্যার’। ডিরেক্টার যা বলবে ম্যানেজারকে তাই করতে হবে আবার ম্যানেজার যেটা বলবে অ্যাসিস্ট্যান্টরা মুখ বুজে তাই পালন করবে। না হলে ওই ‘লাথ মারকে ভাগা দেগা’।

ভুদেববাবু এই ছোট ইংরেজদের খুব কাছের থেকে দীর্ঘদিন লক্ষ্য করেছিলেন। কলোনিয়াল যুগে ইংল্যান্ডের শিক্ষিত, সম্ভ্রান্ত সমাজে ভারতবর্ষ ছিল বাঘ, সাপ, ম্যালেরিয়া আর ন্যাংটা ফকিরের দেশ। মরতে কি কেউ এ দেশে আসে? কারা আসত? খ্রীষ্টান মিশনারিরা আসতো ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে – যীশুর মাহাত্ম্য গেয়ে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য, দেশ শাসনের জন্য আসতো সিভিল সার্ভিস পাশ করা রাজ কর্মচারীরা, শিল্প আর ব্যাবসা করার জন্য ভাগ্যান্বেষী উদ্যোগী যুবকরা আর আসতো চা বাগানে, চটকলে, রেলওয়েতে কাজ করার জন্য অশিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত বাপ-তাড়ান, মায়ে-খ্যাদানো যত এই ছোট ইংরেজরা। তারা কেউ পাবলিক স্কুল, অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ বা স্যান্ডহার্স্ট থেকে পাশ করা ছিল না।    

শিল্প আর ব্যাবসায়ে একছত্র আধিপত্য ছিল স্কটিশদের। স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে ছিল যত চটকল তাই এখানকার  চটকলে বেশীর ভাগই এসেছিল ডান্ডি থেকে কিছু টেকনিক্যাল ট্রেনিং আর মাস্টারের সার্টিফিকেট নিয়ে। দেশে থাকলে হত লেবারার এখানে এসে হল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার আর তার পর ম্যানেজার। গঙ্গার পারে পাঁচশ ছ’শ একর যায়গা নিয়ে এক একটা চটকল। অজস্র গাছ গাছালি বাগান ঘেরা। থাকার জন্য আলিশান বাংলো – চাকর বাকর বেয়ারা বাবুর্চ্চি – টেনিস, স্নুকার, সুইমিং পুল, শনিবার রবিবার বিয়ার পার্টি, এলাহি খানাদানা, নাচাগানা – সব এক একজন ক্ষুদে নবাব – ডান্ডির চটকলে কাজ করলে যা স্বপ্নেও চিন্তা করতে পারত না। কুলি-মজুর-শ্রমিক শ্রেণী প্রথম প্রথম এসেছিল চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, হুগলি অঞ্চল থেকে – পরে পরে যত নতুন নতুন চটকল হতে লাগল তখন বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ থেকে সব আসতে আরম্ভ করল।  

সেই সময়ের কলকাতা ও আশে পাশের অন্যান্য ইংরেজদের তুলনায় এই চটকলিয়ারা ছিল অনেক বেশী সংকীর্ণ মনের। মিলের কম্পাউন্ডের বাইরে এরা কারোর সাথে মেলামেশা করতো না। এমন কি অন্য ইংরেজদের সাথেও না। চটকলের সুখ-সাচ্ছ্যন্দের স্বর্গ ছেড়ে এরা কখনোই বেরোতো না। কেবলমাত্র যদি না অন্য কোন চটকলে পার্টি থাকতো। শুধুমাত্র মাঝে সাঝে কোম্পানির পয়সায় ‘হোমে’ অর্থাৎ দেশে ইংল্যাণ্ডে স্কটল্যান্ডে যেত। অধিকাংশই ছিল ব্যাচেলার। ফলে এদের ছিল লাগামছাড়া উশৃঙ্খল জীবন। এরা ছিল যেমন কিপ্টে তেমনি স্বার্থপর। তবু অনেক বৃটিশ রাজপুরুষের এদেশে শিক্ষা প্রসারে, জ্ঞানের প্রসারে অনেক অবদান আছে কিন্তু এই স্কটিশ জুটওয়ালারা চটকলের বাইরে আশেপাশের এলাকার উন্নতির জন্য কিস্যু করে নি, একটা প্রাইমারি স্কুলও করে দেয় নি। এমন কি চটকলের হাজার হাজার লেবারার যেখানে থাকতো সেই কুলি লাইনের তুলনায় গোরুর গোয়াল বা শুওরের খোঁয়ার ছিল স্বর্গ। সেই আমলে শ্রমিকদের মজুরী ছিল খুবই কম। সাধারণ শ্রমিক থেকে দক্ষ শ্রমিকরা পেত মাসে ছ’টাকা থেকে বড় জোর পঁচিশ টাকা। চাষীদের থেকে পেতো সস্তার কাঁচা পাট – সস্তার লেবার আর উনবিংশ শতাব্দীর শেষে মন্দার বাজারেও লাভ মন্দ হ’ত না আর লাভের গুড় যেত শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে আর আর যত সাহেব কর্মচারীদের মোটা মাইনে আর নবাবি ঠাঁটবাট বজায় রাখতে।  

শ্রমিক-কুলি-মজুরদের একে’তো মাইনে কম তার ওপর টানা নয় ঘণ্টা কাজ – কোন রকম বিশ্রাম নেই। এর সাথে যুক্ত ছিল সাহেব সুপারভাইসারদের অকথ্য গালাগালি, বেতের বাড়ি আর বুটের লাথি। চটকলে ডান্ডালজিটা এরাই চালু করে। ফলে শ্রমিক অসন্তোষ মাঝে মাঝেই মাথা চাড়া দিত। সেই অসন্তোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্য নিজেদের একটা সেনাদল ছিল যার সদস্য ছিল ম্যানেজার থেকে শুরু করে সব সাহেব কর্মচারীরা। এরা এর জন্য নিজেদের কাছে বন্দুক-পিস্তল রাখত – আর সেটা শুধুমাত্র ভয় দেখানোর জন্য নয় – বহুক্ষেত্রে তারা এর সদ্‌ব্যাবহারও করত। ১৮৯৫ সালে বজবজ জুটমিলে প্রায় সাত হাজার শ্রমিক ক্ষেপে গিয়ে ম্যানেজারদের বাংলো এলাকায় জমা হয়ে ইটপাটকেল ছুড়ে জানালার কাঁচ ভেঙে দেয় – সাহেবরাও পুলিশ নিয়ে গুলি ছুঁড়ে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে। এ খবর অমৃত বাজার পত্রিকাতে বেরিয়েছিল।

শাসক দলের লোক হওয়ার জন্য এই সব ম্যানেজার বা তার অ্যাসিস্ট্যান্টদের অসম্ভব ক্ষমতা ছিল। এরাই ছিল কলোনিয়াল মনোভাব আর সংস্কৃতির স্রস্টা আর ধারক-বাহক যার শুরু নীলকর সাহেবদের দিয়ে। এদের কোন শাস্তি হ’ত না – তা না হলে বেতের বাড়ি, বুটের লাথি মারার সাহস এদের হ’ত না। যার জন্য এরা কখনও মিলের বাইরের এলাকায় এমনি বেরোত না – প্রাণের ভয় ছিল, বিশেষতঃ ১৯০৫এ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর। জাতীয়তাবাদী খবরের কাগজগুলো প্রায়ই এরকম খবর দিত। ভুদেব বাবুই বলেছেন ১৯০৬ সালে এই ইন্ডিয়া জুটমিলেই ম্যানেজার কিভাবে গালাগালি দিতে দিতে এক তাঁতিকে লাথির পর লাথি মেরেছিল – সে খবর বেঙ্গলি বলে জার্নালে বেরিয়েছিল। ওই সময়ে রবার্টসন সাহেব চাকরি ছেড়ে দিয়ে ইংল্যান্ডে ফিরে চলে যান। এর কয়েক বছর পরে আমাদের এই জগদ্দলের আলেক্সান্দ্রা জুট মিলে ওব্রায়েন নামের এক ইঞ্জিনিয়ার একটা লেবারারকে এমন লাথি মেরেছিল যে লোকটা মারাই যায়। সে সময়ে কিছু স্বদেশী বিপ্লবী ওব্রায়েনকে খুন করার প্রচেষ্টা করেছিল।     

তখনকার দিনে এই স্কটিশ জুটওয়ালারা চাষীদের আর শ্রমিকদের শোষণ করে চটকল থেকে যা মুনাফা লুঠতো তা চটকলের বা তার নীচুতলার কর্মিদের কোন রকম হিতসাধনে না লাগিয়ে অন্য শিল্পে চালান করে দিত। দুঃখের কথা এই যে  দেড়শ বছর ধরে সেই ধারাটা আজও বজায় আছে – চাষী-শ্রমিকদের অবস্থার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয় নি। যে জাতীয় কর্মসংস্কৃতি ওই ওব্রায়েন, ওয়াটসন, ব্রাউন, মিচেল, স্টিভেনদের দল গড়ে তুলেছিল, চটকলের প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা অক্ষুন্ন ছিল এবং পরবর্ত্তীকালেও ঐ রন্টি মিটার, স্যান্টি বোসদের হাত ধরে এসে এখনও তার ধারা বয়ে চলেছে। সেই – ‘কোথাও এতটুকু তার পরিবর্তন হয় নি’। তবে হ্যাঁ সেদিন এই চাষী-শ্রমিকরা হাতে-ভাতে দুটোতেই মার খেত এখন না হয় হাত বন্ধ হয়েছে কিন্তু ভাতে মারটা খেয়েই চলেছে”।   

ঝোড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সামন্ত বলল – “সাহেব আর দেরী করবোনা। পালাই – আকাশের অবস্থা ভাল না। টিভিতে বলেছে সাইক্লোন আসছে – কলকাতায় নাকি খুব বৃষ্টি হচ্ছে”। প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। সামন্ত চলে গেল। আমিও সকাল সকাল খেয়ে নিলাম। আবদুল ওর কাজ সেরে চলে গেল। এখন নিঃসঙ্গতাই আমার প্রিয় সঙ্গী। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। গঙ্গার ওপরটা শুধু ধোঁয়ার মতন লাগছে। চারিদিক শান্ত নির্জন শুধু একটানা বৃষ্টির শব্দ। বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে। আবদুল একটা সিন্থেটিক ব্ল্যাঙ্কেট বের করে রেখে গেছে। ওটা গায়ে দিয়ে শুয়ে চুপচাপ ভাবছি। সামন্তর কথাগুলো কেবল মনে হচ্ছে। কখন যে ঘুমিয়ে গেছি জানি না। মাঝে যখনই দু’এক বার ঘুম ভেঙেছে – বিদ্যুতের ঝলকানি আর বাজ পড়ার শব্দ পেয়েছি।

(৮)   

আজ আঠাশে সেপ্টেম্বর, ১৯৯০ শুক্রবার। দিনটা জীবনে কোনদিন ভুলতে পারলাম না। ভোরে ঘুম ভাঙতেই উঠে দরজা খুলে বারান্দায় এলাম। ছাতা মাথায় দিয়ে আবদুল এল। আজ আবার মিলের সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। আবদুলের সাথে আর একজন আজ এসেছে – নাম ইকবাল, গেস্ট হাউসেরই স্টাফ। মুলুক গিয়েছিল – উত্তর প্রদেশের আজমগড় জেলায়। আগে ব্যাচেলার মেসের ক্যান্টিনে কাজ করত – বছর দুয়েক ধরে এখানে আবদুলের অ্যসিস্ট্যান্ট। বয়স হয়ে গেছে – আবদুল এবছর রিটায়ার করে চলে যাবে ওর দেশের বাড়ি।  

আবার জোরে বৃষ্টি নামল। বারান্দায় ছাট আসছে, বসা যাচ্ছে না। ঘরের মধ্যেই দরজার সামনে চেয়ার টেনে বসলাম। বৃষ্টির চোটে গঙ্গার ওপার কিছু দেখা যাচ্ছে না। একটা নৌকাও আজ নেই। মিলের ষ্টীমারটা জেটিতে নোঙ্গর বাঁধা আছে। আমার চুপচাপ বসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আজ কোনও কাজও নেই। তাও সে আসবে বিকেলের দিকে। এমন এক অদ্ভূত আলস্যের দিন কাটিয়েছি বলে মনে পড়ে না। দু’প্রস্থ কফি, ব্রেকফাস্ট সব হয়ে গেল। বসে বসে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি। কোয়ালিটি কন্ট্রোলের একটা লোক এসে আমার নামে একটা বড় খাম দিয়ে গেল। সামন্ত সাহেব পাঠিয়েছেন। উনি আজ আসেন নি। খুলে দেখলাম প্রদীপ কুণ্ডু যে টেস্টগুলো করেছে তার রেসাল্ট আর রিপোর্ট – সামন্তর সই করা। একটু দেখে আমার ব্যাগে রেখে দিলাম। ফিরে গিয়ে সব অ্যানালিসিস করতে হবে। গাড়িটা কখন যে আসবে। এতদিন কাজের তোড়ে ছিলাম, কিছু মনে হয় নি। আর এখন মনে হচ্ছে কতক্ষণে ফিরে যাব।   

এগারটা নাগাদ মিলের অফিসে এলাম। একটু খোঁজ নিয়ে দেখি। অফিসে ফোন করলাম প্রথমতো কেউ ধরেই না। সব কটা লাইনেই কোঁ কোঁ করছে নয়তো রিং হয়ে চলেছে। আরে ব্যাপারটা কি? বেশ খানিকটা চেষ্টার পর ফোন ধরল আমাদের মেন গেটে – দারোয়ান বুধন সিং। বার্তা যা পেলাম – অত্যন্ত হতাশাজনক। গাড়ি আজ আর আসবেনা। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকেই কলকাতায় প্রবল বৃষ্টি হয়েছে – আমাদের অফিস, আশেপাশের এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর জল। গ্যারাজ থেকে গাড়ি বের করাই যাচ্ছে না। জনা পনেরো লোকও অফিসে আসে নি। অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। আমার গাড়ি কাল সকালে নকুল নিয়ে আসবে। এখন কি করব? বাড়িতে একটা ফোন করে জানিয়ে দিলাম।

মিঃ সোমানি এলেন। আমাকে দেখেই হাত দিয়ে ডেকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলেন।

“নাস্তা করেছেন?” প্রথমেই জিজ্ঞাসা করলেন।

আমি বললাম –“হ্যাঁ”।

মিঃ সোমানি বললেন – “তা’ হলে কফি খান”। বলে বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে কফি আনতে বললেন।

আমি বললাম – “আমার তো আজ চলে যাওয়ার কথা ছিল। কলকাতায় বৃষ্টির জন্য গাড়ি আসতে পারবে না”।

মিঃ সোমানি বললেন – “আই নো ইট। আপনার অফিস থেকে মুখার্জ্জী সাব ফোন করেছিলেন। আপনাকে বলতে বলেছেন। আমি ওনাকে বলেছি কোন চিন্তা করবেন না। ওনার সব দায়িত্ব এখন আমার। আপনি আরামসে আজ এখানে থাকুন। এরকম সাইক্লোনে আমি আপনাকে ছাড়বোনা। কাল গাড়ি আসেতো ঠিক আছে না হলে আমি আমাদের গাড়ি দিয়ে আপনাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে দেব”।

আমি হেসে খুব থ্যাঙ্কস জানালাম। কফি, ক্রীম বিস্কিট, রোস্টেড কাজু এলো – খেতে খেতে এ কথা সে কথা হচ্ছে। আধাঘন্টাটাক থেকে ঘোষসাহেবের ওখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেস্ট হাউসে ফিরে এলাম। বৃষ্টি কখনো থামছে, আবার কখনো ঝেঁপে আসছে। বৃষ্টির এই লীলা খেলা দেখা ছাড়া আমার আর কোন কাজ নেই। খুব ভুল করেছি – একটা কোন বই, ম্যাগাজিন-ট্যাগাজিন নিয়ে এলে ভাল করতাম। যাকগে স্নানটান সেরে একটা নাগাদ খেয়ে ঘুম। আবদুল এই ঝড়-বাদলেও পাঁঠার মাংস জোগাড় করে এনেছে।

ঘুম ভাঙল প্রায় সাড়ে চারটে। বৃষ্টিটা ধরেছে। কিন্তু আকাশে এখনও ঘন মেঘ। বারান্দায় কফি নিয়ে বসলাম। গাছের পাতা, ডাল সব ভিজে চুপচুপ করছে। কাকগুলো ভিজে কি অবস্থা এক একটার। সামন্ত থাকলে বেশ ভাল হ’ত। এই চটকলের ইতিবৃত্ত আরও জানা যেত। গতকালের সামন্তর কথাগুলো কেবল মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আচ্ছা আবদুল শুনেছি এই মিলের সবচেয়ে পুরোন লোক। ওর যা বয়স তাতে তো স্বাধীনতার আগে থেকেই ওর এখানে থাকার কথা। ওর নিশ্চয়ই অনেক অভিজ্ঞতা আছে। শুনতে হবে তো। আমি আবদুলকে ডাকলাম।

সারাটা বিকেল, সন্ধ্যা আবদুলের সাথে কথা বলে কাটল। পঁয়ষট্টি পেরিয়া যাওয়া একজন মানুষের – যে জীবনের প্রায় ষাট বছরেরও কাছাকাছি চটকলে কাটিয়েছে – যার তিনপুরুষ মিলে একশ বছর ধরে চটকলের সাথে জড়িত, তার অভিজ্ঞতার মূল্য আমার কাছে অপরিসীম।     

আবদুলের দেশ বিহারে, পূর্ব্ব চম্পারণ জেলার মতিহারি তহসিলে। অনেক ছোটবেলায় – সে মনে নেই – আম্মা আর চাচার হাত ধরে মুলুক ছেড়ে চলে এসেছিল কলকাতায়। সে বড় যুদ্ধের অনেক আগে। তখন সাহেবরাই দেশ চালাত। আব্বা অনেক আগেই চলে এসেছে। চন্দননগরে গোঁদলপাড়ার চটকলে কাজ করত। সেখানে কুলি লাইনে ওরা থাকত। চাচাও চটকলে সাহেবদের মেসে রসুইয়ের কাজে লেগে গেল। চাচা মুলুকে থাকতেই ভাল রান্না করতে পারত। কয়েক বছর পর এই এডোয়ার্ড মিলের এক সাহেব আবদুলের চাচাকে নিজের খাস বাবুর্চ্চি করে এখানে নিয়ে আসে। আবদুল স্থানীয় একটা প্রাইমারী স্কুলে বছর চারেক পরেছিল। হিন্দি লিখতে পড়তে জানে। বছর দশ বারো যখন, তখন ওর আব্বাজানের এন্তেকাল হয়ে যায়। মা মুলুক চলে যায়। ওখানে ওর আরও দুই দাদা ও অন্যান্য আত্মীয় স্বজন সব আছে। ও শুধু এখানে চাচার কাছে থাকত।

এখানে চাচা যার বাবুর্চ্চি ছিল সে ছিল এখানকার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার – মরিস সাহেব। এ সাহেবটা অন্যদের মতন ছিল না। তবে খুব খেতে ভালবাসতো। ওনার মেমসাহেবও এখানে থাকত। ওদের একটা ছোট ছেলে ছিল। ওকে দেখার জন্য আয়া ছিল। আবদুলকে মেমসাহেব পছন্দ করত – ওনার টুকটাক ফাই ফরমাস খেটে দিত আর চাচাকে কাজে সাহায্য করত। ওর কোন মাইনে ছিল না তবে দুবেলা খাবার পেত। চাচার কাছে থাকতে, থাকতে আবদুল কয়েক বছরের মধ্যে ভাল রান্না শিখে গেল। এর পর থেকে চাচা এক-দু’মাসের জন্য দেশে চলে গেলে আবদুলই রান্না করত। অবশ্য এর জন্য আলাদা করে টাকা পেত। মেমসাহেবের কাছ থেকে আবদুল নানা ধরণের স্যূপ, স্যালাড, স্যান্ডউইচ, কেক, পুডিং বানান শিখেছিল।    

যখন যুদ্ধ লাগল চটকলের কাজ খুব বেড়ে গেল। তখন তিন শিফটেই কাজ হ’ত। কিছু নতুন সাহেব এল। মরিস সাহেব তখন ম্যানেজার। আবদুল ব্যাচেলার সাহেবদের কোয়ার্টারে রান্নার কাজ পেয়ে গেল। তখনও বেশীর ভাগই ব্যাচেলার ছিল। ম্যানেজারের বাংলোর পরে যে তিনতলা বড় বিল্ডিঙটা সেটাতে থাকতো অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, সুপারভাইসার সাহেবরা।  এলাহি খানা দানা ছিল এই সব সাহেবদের। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে বেয়ারারা ঘরে নিয়ে যেত চা, বাটার-টোস্ট, আর ডবল ডিম – পোচ, সেদ্ধ, স্ক্র্যাম্বল বা অমলেট – যার যে রকম রুচি। এটা অবশ্য ব্রেকফাস্ট নয়। এর নাম ছিল ‘ছোটা হাজিরি’। কিছুক্ষণ মিলে লেবার ঠেঙিয়ে এসে হ’ত আসল ব্রেকফাস্ট। কয়েক কোর্সের খাওয়া – ভাত, ফাউল কারি, মাছ, বিফ স্টিক, স্টু, ডিম, ব্রেডবাটার, জ্যাম আর তার সাথে চা-কফি। তবে বেশীর ভাগ পছন্দ করত বিয়ার আর বরফ জল। আবার কারোর কারোর পছন্দ ছিল পেগ। এই পেগ হ’ল বড় এক টাম্বলার গ্লাস ভর্তি হুইস্কি, সোডা ওয়াটার আর বরফ। এই পেগের ঠেলায় কত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পন্ন ইংরেজ যুবক যে অধঃপাতে গেছে আর অকালে প্রাণ হারিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।  দুপুরের লাঞ্চ ওই ব্রেকফাস্টের মতনই তবে পরিমাণে কম। সন্ধেবেলা মিলের ডিউটি শেষ হলে স্নান সেরে, ধোপ-দুরস্ত জামাকাপড় পরে – স্নুকার, টেনিস খেলা আর একসাথে ডাইনিং হলে ডিনার – স্যুপ, মাছ, নানা রকম সাইড ডিস, পুডিং আর বিভিন্ন রকম মরশুমি ফল। সাথে বিয়ার, পেগ, ওয়াইন সে সব তো আছেই। এ ছাড়া প্রায়ই পার্টি লেগে থাকত।  

আজাদির জোড় লড়াই শুরু হবার পর থেকে অর্থাৎ ওই ১৯৪২এর পর থেকে নতুন করে চটকলে সাহেব আসা কমে গেল। তখন আমাদের দেশীয় লোকদের জুনিয়র সুপারভাইসার, অফিস ক্লার্ক করে নেওয়া হ’ত। তবে এরা তখনও সাহেবদের সাথে মিলে বা অফিসে মিশলেও তাদের সাথে একসাথে থাকার বা খাওয়াদাওয়ার সুযোগ পেত না। দেশ স্বাধীন হলে পর বেশীর ভাগ ওপরতলার সাহেবরা স্বদেশে ফিরে যায়। তখন কাঁচা পাটের অভাবে অনেক চটকল বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কিছু চটকল সাহেব কোম্পানিদের থেকে মাড়োয়ারিরা কিনে নেয়। আজাদির পর এখানে ম্যানেজার ছিল জেনকিন্স সাহেব। আবদুল তখন ওনার খাস বাবুর্চ্চি ছিল। বছর দশ বার পর উনি রিটায়ার করে দেশে চলে গেলেন। তার পর থেকেই আবদুল এই গেস্ট হাউসের কেয়ারটেকার। স্টুয়ার্ট কোম্পানি তাদের ব্যবসা গুটিয়ে চলে গেল তখন এই মিলটা গোলেচা বলে এক মাড়োয়ারি কিনে নেয়। সত্তরের পর থেকে মিলে খুব গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। মিলে তিন চারটে মজদুর ইউনিয়ন ছিল। প্রায়ই স্ট্রাইক হ’ত। দু’তিন বার লক আউট হয়। গোলেচার থেকে হাত বদল হয়ে মালিক হন ভারতিয়া। বছর তিনেক পরে পঙ্কজ মেঙ্ঘানি মিলটা কিনে নেন। গত আট বছর ধরে মিলটা ভালই চলছে। অনেক এক্সপোর্ট অর্ডার পাচ্ছে। নতুন করে কার্পেট মেসিন বসছে। আর একটা ফ্যাক্টরি শেড তৈরী হচ্ছে – সেখানে শুধু এক্সপোর্টের জন্য সুতো তৈরী হবে।   

সোমানি সাহেব লোক খুব ভাল। খুব কাজ ভালবাসেন। সারাদিনই প্রায় মিলে পড়ে থাকেন। নিজে কাজ দেখেন। তাই সুপারভাইসার, ওভারসিয়ার বাবুরাও তটস্থ থাকেন। এখনতো আর এদের কোন দাপটই নেই। আগে আগে যখন সাহেবরা ছিল কাজ একটু এদিক ওদিক হলেই কথায় কথায় গালাগালি দিত, বেত মারতো, লাথি মারত। মিলের থেকে ঘাড় ধরে বার করে দিত। কেউ কিছু বলতে সাহস পেত না। আবদুলও দেখেছে ওর চাকরির প্রথম দিকে ওই আজাদির কিছু আগে পরের সময়ে – তখনও সাহেবদের খুব দাপট ছিল। তবে আগের মতন অত মারধোর করতোনা। দাঙ্গার সময় থেকে সাহেবরা একটু ভয় পেয়ে গেল।     

কিন্তু একটা সময়ে এই স্কটিশ জুটওয়ালারা নীলকর সাহেবদের তুলনায় কম অত্যাচারী ছিল না। সে কাহিনী আবদুল শুনেছে তার আব্বার কাছে, চাচার কাছে। মোতিহারি শহর থেকে প্রায় মাইল চার-পাঁচেক দূরে মাহমুদ নগর গ্রামে আবদুলের বাপ দাদাদের কিছু জমি জমা ছিল। তাতে পাট চাষ হত। পাটের সূতলি বানিয়ে, তাঁতে চটের কাপড় বুনতো আবদুলের দাদাজান ইদ্রিশের আব্বা। দাদাজানও তাঁত চালাতে জানতো। ভাল রোজগার ছিল। তখনকার দিনে সে সব হাতে বোনা পাটের সূতো, দড়ি, চটের কাপড়, বস্তা বিদেশে চালান যেত। কলকাতার আশপাশে অনেক চটকল গড়ে ওঠায় হাতে বোনা চটের বাজার চলে গেল। সে সময় মন্দার বাজার চলছে। ইদ্রিশের তখন উমের কম। আশপাশের গাঁয়ের অনেকের সাথে কলকাতা চলে এল চটকলে, কারখানায় কাজ করবে বলে। কাপড় বোনার কাজ জানতো বলে একটা নতুন চটকলে তাঁতঘরে কাজ পেয়ে গেল। ভাল কাজ জানতো বলে পয়সা একটু বেশী পেত।   

সে সময়ে তাঁতঘরে এক নতুন সাহেব আসে – ম্যালকম সাহেব। দিনরাত দারু খেতো – আর সবাইকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করত। কথায় কথায়, সূতো ছিঁড়লে পর জোড় লাগাতে বা মাকু পাল্টাতে একটু দেরী হলেই বেত মারতো, বুটের লাথি মারতো। অন্যান্য সাহেবরাও মারতো – তবে ম্যালকম সাহেবের মতন না। ও ছিল একদম ক্ষ্যাপা ঘোড়ার মতন। ইদ্রিশের সাথে কাজ করত বদ্রীপ্রসাদ। ওর বাড়ি মতিহারির জামলা গ্রামে – ইদ্রিশের গ্রামের কাছাকাছি। বদ্রীপ্রসাদ অতটা দক্ষ ছিল না। ওর কাজে একটু দেরী হত। আর ম্যালকম সাহেব রেগে গিয়ে ওকে ভীষণ মারতো। বেচারা কি করবে। পেটের দায়ে দেশ ছেড়ে এসে চটকলে কাজ করছে। দেশে বাপ-দাদার কিছু জমিজমা ছিল। দেনার দায়ে সব মহাজনের কাছে বিকিয়ে গেছে। বদ্রীপ্রসাদ মনে মনে গজরাতো – কিন্তু কিছু করতে পারতো’ত না। এক এক দিন রেগে বলত – এই বদমাশ সাহেবের একদিন জান নিয়ে নেবে। তার পর যা হয় হবে। কত আর বয়স – ইদ্রিশের মতনই – বাইশ-চব্বিশ হবে। তরতাজা জোয়ান মরদ – রক্ত গরম।     

একদিন এরকমই বর্ষাকাল। সেদিন বদ্রীপ্রসাদের তাঁতটা ভাল চলছিল না। বার বার বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সাহেব এসব অত বুঝতো না – ওর ধারণা বদ্রীপ্রসাদ ইচ্ছে করে ফাঁকি মারার চেষ্টা করছে। আগে দুতিন বার বেত চালিয়েছে। বদ্রী কিছু বলেনি। একবার হল কি – বদ্রীর তাঁতের টানার বেশ কয়েকটা সুতো ছিঁড়ে গেল। তাঁত থামিয়ে সেগুলো জোড়া দিতে একটু সময় লাগছে। ম্যালকম সাহেব হঠাৎ দেখে প্রচণ্ড ক্ষেপে গেল। এসেই বদ্রীকে সপাং সপাং বেত মারতে লাগল। বদ্রী আর সহ্য করতে পারল না। ঘুরে সাহবের হাত থেকে বেত কেড়ে নিল। কি নেটিভ কালা আদমির এত বেয়াদবী। সাহেব তাতে আরও ক্ষেপে গিয়ে বদ্রীকে এলোপাথাড়ি ঘুষি চালাতে শুরু করল। সাহেব লম্বা আর খুব গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। বদ্রীর নাক-মুখ ফেটে রক্ত বেড়িয়ে এল। ইদ্রিশ পাশেই ছিল। বদ্রীকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেও ঘুষি খেল। এর পরে একটা মোক্ষোম ঘুষি লাগল বদ্রীর কানের ঠিক নীচে, ঘাড়ের দিকে। আর সাথে সাথে বদ্রী ছিটকে মাটিতে পড়ল। তার পরেও সাহেব গিয়ে গোটা দুয়েক বুটের লাথি মারল। ইতিমধ্যে আর তিন চার জন সাহেব সুপারভাইসার, ওভারসিয়ার যারা ছিল তারা ছুটে এসে ম্যালকমকে ধরে সরিয়ে নিয়ে এল। ম্যানেজার তখন মিলের মধ্যেই ছিল। খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে বদ্রীর অবস্থা দেখে সব সাহেবদের নিয়ে ফ্যাক্টরির বাইরে চলে গেল।    

এদিকে বদ্রীপ্রসাদ ওই যে ছিটকে পড়ল – আর নড়ে চড়ে না – মার খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। ওখানে এক সর্দার ছিল ও নাড়ি দেখতে জানত – কিছু কিছু কবিরাজি দাওয়াইও দিতে পারত। চটকলের শ্রমিকদের ওই ছিল বলতে গেলে ডাক্তার। ও এসে নীচু হয়ে বদ্রীর হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ দেখে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল –‘হায় রাম! ইয়ে তো মর গয়া রে’।  সে কথা শুনে সব লেবারার কাজ বন্ধ দিল। আচমকা ঘটনার পরিস্থিতিতে সবাই এতটা ঘাবড়ে গেছে কি করা উচিৎ বুঝতে পারছে না। সর্দাররাও ঘাবড়ে গেছে। কিছুক্ষণ বাদে থানা থেকে তিন জন সাহেব পুলিশ আর দুজন দেশী কনস্টেবল এল। তখন ম্যালকম সাহেব ছাড়া অন্যান্য সাহেবরা তাদের সাথে ফ্যাক্টেরিতে এল। সবারই হাতে হয় পিস্তল নয় রাইফেল। লেবারাররা সবাই ভয় পেয়ে গেল। বেশী ভয় পেল ইদ্রিশ – ও আবার বদ্রীকে বাঁচাতে গিয়েছিল। একজন সাহেব বদ্রীকে দেখে ম্যানেজারকে কি বলল। সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল – তাই কি যে হল কিছু বোঝা গেল না। সবাই মিলে মিলের অফিসে চলে গেল কনস্টেবল দুজন শুধু রয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পর ওরা বদ্রীকে একটা গরুর গাড়িতে শুইয়ে হাসপাতালে নিয়ে চলে গেল।

পরদিন থেকে আবার কাজ চালু হয়ে গেল শুধু ম্যালকম সাহেব এলেন না। এখানকার এক সর্দারের ওই কনস্টেবলদের একজনের সাথে খুব জানপহেচান ছিল। এক গ্রামের লোক। তার কাছ থেকে জানল – পুলিশ বলেছে বদ্রীপ্রসাদ নাকি ম্যালকম সাহেবকে সুতো কাটার বড় ছুরি দিয়ে খুন করতে এসেছিল সাহেব নিজের প্রাণ বাঁচাতে ওকে ধাক্কা মারে – তাতে পড়ে গিয়ে লোহার খাম্বাতে চোট পেয়ে বদ্রী মরে যায়। এটা একটা নেহাত দুর্ঘটনা। ইদ্রিশ শুনে হতভম্ব হয়ে গেল – বদ্রীপ্রসাদ ওর খুব বন্ধুলোক। এতটা মিথ্যে ও সহ্য করতে পারল না। পরদিন খুব সকালে নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে ব্যান্ডেল চলে যায়। সেখান থেকে ট্রেন ধরে মুজফফরপুর হয়ে দেশে ফিরে আসে। আর জীবনেও কোনদিন কলকাতা ফিরে আসে নি। তাঁতে গামছা, ধুতি সব বানিয়ে স্থানীয় হাটে বিক্রি করে সংসার চালাত।

আবদুলের আব্বাও তাঁতের কাজ শিখেছিল। জমি জমার চাষ আবাদ কিছু কিছু হত। যুদ্ধের সময়ে আবার নীল চাষের জন্য জবরদস্তি সুরু হয়। ইদ্রিশের কিছু জমি জমিদার জোর করে নিয়ে নেয়। তখন চম্পারণে বাপুজির আজাদির লড়াই শুরু হয়েছে। ইদ্রিশও ওই লড়াইয়ে সামিল হয়। বছরখানেক বাদে ইদ্রিশের এন্তেকাল হয়ে যায়। আবদুলের জন্মের সময়ে বাজার খুব মন্দা ছিল। হাতে বোনা কাপড় থেকে কলে তৈরী কাপড় সস্তা হত। আবদুলের আব্বাও একদিন ওই দাদাজানের মতন কোলকাতায় চলে এসে গোঁদলপাড়ার চটকলে কাজ নেয়। তারপর চাচাও চলে আসে। আজাদির পরে চাচা চটকল ছেড়ে কলকাতায় একটা বড় হোটেলে রান্নার কাজ করত।       

  

(৯)

আবদুলের কাহিনী শুনতে শুনতে প্রায় আটটা বেজে গেল। বাইরে বৃষ্টি ধরে গেছে। আবদুলকে বললাম খাবার দিয়ে দিতে। ও কাল সকালবেলা মাসখানেকের জন্য দেশে যাবে। আমি আবদুলকে একশ টাকা দিলাম – দেশে কিছু মিঠাই কিনে নিয়ে যাবার জন্য। ও কিছুতেই নেবে না – অনেক বলার পর নিল। সাড়ে নটার সময়ে সব কাজ সেরে আবদুল আর ইকবাল দুজনেই চলে গেল। কেন জানি না কিচ্ছু ভাল লাগছে না। আবদুলের দাদাজানের কাহিনী শোনার পর থেকে বিজাতীয় ক্রোধ, ঘৃণা, দুঃখ সব মিশিয়ে মনটা খুব বিষিয়ে আছে। তার ওপর নিঃসঙ্গ – একা। আর একজন থাকলেও না হয় গল্পটল্প করে একটু হাল্কা  হওয়া যেত। মনটার ওপর যেন দশ মণ পাথর চেপে বসে আছে।

কিচেনে টেবিলের উপর আবদুল রোজ একটা ইলেক্ট্রিক কেটলি, কফির শিশি, চামচ, কফি মগ, জলের জগ সব গুছিয়ে রেখে যায়। অনেক সময়ে আমি রাত্রে কফি বানিয়ে নিই। এক কাপ কফি করে বড় লম্বা সোফাটায় এসে বসলাম। বাইরে আবার জোর বৃষ্টি নামল। আবদুলের কথাই ভাবছিলাম। এ কটা দিন কি যত্নআত্তিই না করেছে। যা ভাল লাগে খেতে তাই বানিয়ে দিয়েছে – ঠিক সময় বুঝে কফির কাপ দিয়ে গেছে। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে – বলতে হয় নি। ঠিক নতুন প্যাকেট এনে টেবিলে রেখে দিয়েছে। অথচ কত নির্লোভ – আমাকে জোর করে একশ টাকা দিতে হ’ল। ধর্মনিষ্ঠ – কাজের মধ্যেও ঠিক সময় মতন নমাজ পড়ে নিত। আবদুলের ব্যবহার, কথাবার্তায় বোঝা যেত ওর আব্বা-দাদাজানরা গরীব হতে পারে কিন্তু ভদ্র পরিবারের। তখনকার দিনে বাংলা, উড়িষ্যা, বিহার, উত্তর প্রদেশ থেকে চটকলে বা অন্যান্য কারখানায় যারা কুলি-মজুর হয়ে কাজ করতে এসেছিল তারা অনেকেই মোটামুটি অবস্থাপন্ন ছিল – জমিজমা, চাষবাস ছিল। নীলকর সাহেব, স্থানীয় জমিদার, জোতদার আর মহাজনদের অত্যাচারে, মিথ্যে মামলায় সর্ব্বস্বান্ত হয়ে পেটের দায়ে কলকারখানায় কুলি মজুরের কাজ করতে বাধ্য হয়। এরা কেউ চোর, ডাকাত,‌ গুণ্ডা বদমাশ ছিল না – যে পিটিয়ে শায়েস্তা করতে হবে। বরঞ্চ বলতে হয় সমাজের উঁচু তলার ভদ্রলোকের মুখোস পরা চোর, ডাকাত,‌ গুণ্ডা বদমাশদের অত্যাচারেই তাদের দৈন্যদশা কোনদিন ঘুচল না।  

ইদ্রিশ, বদ্রীপ্রসাদ এরা যেমন পেটের দায়ে দেশ-ঘরবাড়ি ছেড়ে চটকলে নাম লিখিয়েছিল – ঠিক তেমনি ওই ম্যালকম,  ওব্রায়েনরাও পেটের দায়ে দেশ-ঘরবাড়ি ছেড়ে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ভারতবর্ষে এসে এই চটকলে নাম লিখিয়েছিল। অথচ শুধুমাত্র শাসক দলের জাত বলে কুলি-মজুর না হয়ে হ’ল ওপরওয়ালা সুপারভাইসার, ম্যানেজার আর পেটে বিদ্যাবুদ্ধির অভাবে লাঠি ঘোরাতে আরম্ভ করল আর যতটা পারল কাঁচা পয়সা লুটে উশৃঙ্খল জীবন যাপন করে ফূর্তি করতে লাগল। এদের কোন শিক্ষা সংস্কৃতি ছিল না। চটকলে, চা বাগানে, রেলে, কলকারখানায়, পুলিশে এইসব ছোট ইংরেজরাই কলোনিয়াল যুগে ব্রিটিশ শাসনকে কলঙ্কিত করেছিল। অথচ সেদিন ওই চটকলে এমন কারা ছিল না যে ওই ম্যালকমকে গণধোলাই দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলত। আসলে সহিষ্ণুতা ভারতবাসীর মজ্জায়, রক্তে। এরা মার খেতে জানে, দিতে জানে না। এরা জান দিতে জানে নিতে জানে না। চটকলের মজদুররা তখনও সঙ্ঘবদ্ধ হতে শেখে নি। আর এই ম্যালকম একটা মানুষকে খুন করে কি সুন্দর পার পেয়ে গেল, কোন রকম সাজাই হল না, উলটে একটা জলজ্যান্ত খুনকে দুর্ঘটনা বলে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া হ’ল। নিশ্চয়ই বাকি জীবন সে বহাল তবিয়তে কাটিয়ে গেছে। বেচারা বদ্রীপ্রসাদ!

**********  

…কি ব্যাপার? বাইরে কিসের শব্দ? মনে হচ্ছে কাঠের সিঁড়ি দিয়ে কে যেন ওপরে উঠছে। এত রাত্রে আবার কে আসবে? আবদুল অবশ্য ইকবালকে বলছিল যে আগামী কাল দুজন গেস্ট আসবে – ক’দিন থাকবে। তা’ ওরাই এল নাকি – এত রাত্রে? কি জানি! হয়তো দারোয়ান দরজা খুলে দেবে। ঘোষ সাহেব বলছিলেন ট্র্যান্সফরমার সারভিস করবার জন্য দুজন ইঞ্জিনিয়ার ভূপাল থেকে আসবে। তারাই বোধ হয় এল। হয়তো ট্রেন বা প্লেন লেট করেছে। কিন্তু তাদেরতো কাল আসার কথা।

না – একটা খুব চ্যাঁচামেচি শুনতে পাচ্ছি। কে যেন খুব জড়ানো গলায় চিৎকার করছে। বুকটা ধক করে উঠল – কে রে বাবা? কথা কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে খুব ড্রিঙ্ক করে এসেছে। এ ক’দিন আছি – এ রকমতো কখনও দেখি নি। “গেত আউত, গেত আউত ইউ ব্লাডি…” – কি রকম একটা ঘরঘরে জড়ান গলায় কে যেন কাকে ইংরেজিতে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করছে। কি হল? অ্যালান আবার ফিরে এল নাকি। কিন্তু ওকে আগে যে টুকু দেখেছি – ওতো এ ধরণের নয়। অন্য কেউ এল? আমি তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এ কি চারিদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার – লোড শেডিং হয়ে গেছে নাকি? আমার ঘরের আলো নেভানো ছিল, ঠান্ডার জন্য ফ্যান বন্ধ ছিল বলে বুঝতে পারি নি। দোতলায় যাবার কাঠের সিঁড়িতে ক্ষীণ আলো। আওয়াজটাতো ওপর থেকেই আসছে। আমি সেই আলো-আঁধারি সিঁড়ি বেয়ে তর তর করে ওপরে উঠে এলাম।         

ওপরে সিঁড়িতে ওঠার দেয়ালে ব্র্যাকেটে একটা কাঁচের চিমনি দেওয়া পেতলের তেলের ল্যাম্প লাগান। সে ল্যাম্পের আলোয় সিঁড়িটা আলোকিত। আমি তাড়াতাড়ি উঠে বারান্দায় এলাম। নীচের বারান্দার মতনই চওড়া বারান্দা। মাঝে বড় দরজা খোলা – ঘরে টেবিলে একটা বড় তেলের চিমনি দেওয়া পেতলের ল্যাম্প। একটা সাহেব – ইয়া গাঁট্টাগোট্টা – পরনে একটা টার্টান ট্রাউসার, শার্ট, ওয়েস্ট কোট আর তার ওপর হাঁটু অবধি লম্বা টেইল কোট, কালো বুট জুতো, গলায় সিল্কের স্কার্ফ, মাথায় ফেডোরা হ্যাট, হাতে একটা বড় মদের বোতল – টলছে, ভাল করে দাঁড়াতেই পারছে না। বোতলটা একটা গোল টেবিলের ওপর ঠক করে রাখল। টুপিটা খুলে সামনে একটা হ্যাট স্ট্যান্ডে রাখল। মাথায় ঝাঁকড়া, কোঁকড়ান অবার্ন চুল, মুখে ঘন লালচে-বাদামি গোঁফ দাঁড়ি গলা ঢেকে ফেলেছে, নীল চোখ মদের নেশায় বুজে আসছে, চোখ টেনে টেনে তাকাচ্ছে। দরজার পাশে আঙুল তুলে কাকে যেন শাসাচ্ছে – “হু আর ইউ – গেত আউত – আই উইল খিল ইউ – ইউ দ্যাম ব্ল্যাকি – ইউ ব্লাডি, বিস্ট…”।            

কাকে বলছে? হঠাৎ দেখি আমারই সামনে দাঁড়িয়ে একটা লোক – এতোক্ষণ তো খেয়াল করিনি – এল কোত্থেকে? হাঁটু অবধি ময়লা খাটো ধুতি, ততোধিক ময়লা ছেঁড়া বেনিয়ান, মাথার চুল যতদূর ছোট করে হয় ছাঁটা, কাঁধে ময়লা গামছা।  ক্ষীণ আলোয় লোকটাকে বেশ অস্পষ্ট দেখাচ্ছে। সাহেব ঘুরে সামনের একটা টেবিলের ড্রয়ার থেকে পিস্তল বার করে কোটের পকেটে রেখে টেবিলটা ধরে কোনমতে টলতে টলতে দাঁড়াল। লোকটাকে মনে হ’ল কি রকম সাহেবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সাহেব আবার হঠাৎ – “আই মাস্ত  খিল ইউ – হাউ ডেয়ার ইউ, ইউ ব্লাডি রাস্কেল বাড্রি” – বলে এবার দেখি পকেট থেকে পিস্তল বার করার চেষ্টা করছে। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে ‘আবদুল’, ‘আবদুল’ করে চিৎকার করছি। এই রে লোকটাতো  মরে যাবে। কিন্তু আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। সাহেব নেশায় এত টলছে গুলি যে কোন দিকে ছুড়বে কে জানে। আমার পা কি রকম মাটির সাথে যেন আটকে গেছে – পালাতেও পারছি না। আমি ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। লোকটা যেন ক্রমশঃ সাহেবের দিকে এগিয়েই চলেছে। সাহেব “নো, নো স্টপ ইউ স্কাউন্ড্রেল” – বলতে বলতে পকেট থেকে পিস্তল বার করতে না করতেই দু বার ফায়ার করে বসল। আর সাথে সাথে নিজেই নিজের পেট চেপে দড়াম করে সামনের গোলটেবিল সমেত কাটা গাছের মতন হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ল। মদের বোতল ভেঙে চুরমার।           

আমি চিৎকার করে “আবদুল”, “আবদুল” করছি। লোকটাকেও আর দেখছি না । আলোগুলোও নিভে কেমন সব অন্ধকার হয়ে গেল। আর কে যেন আমার মুখ চেপে আমাকে ফেলে আমার বুকের ওপর বসে আছে। আমি দু হাত দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছি নিজেকে ছাড়াতে – কিন্তু পারছি না। চিৎকার করে আবদুলকে ডাকতে চেষ্টা করছি – পারছি না। মনে হচ্ছে আমার ওপর কে যেন একটা ভারী পাথরের স্ল্যাব চাপিয়ে দিয়েছে যা সমস্ত শক্তি দিয়েও ঠেলে সরাতে পারছি না। হঠাৎই যেন পাথরটা সরে গিয়ে শরীরটা হাল্কা হয়ে গেল আর আমিও কেমন ছাড়া পেয়ে গেলাম। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। বুকটা অসম্ভব ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ – ঢোক গিলতে পারছি না।       

********** 

ঘরে আলো জলছে – সামনে সেন্টার টেবিলে কফির মগ, সিগেরেটের প্যাকেট, দেশলাই। সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম! বিছানাতেও যাই নি। উঃ কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! আর কি যে স্পষ্ট দেখেছি কাউকে কখনও বোঝাতে পারব না। স্বপ্নতো প্রায় রোজই দেখি। কেমন ভাসা ভাসা – ছায়ার মতন। কিন্তু এ রকম স্পষ্ট সিনেমার মতনতো নয়। হ্যাঁ অনেক আগে একবার দেখেছিলাম। একদিন দুপুরে একা ঘরে একটা গল্পে নির্জন পাহাড় আর তার পাশে একটা বড় লেকের বর্ণনা পড়ে সেটা চোখ বুজে ভাবতে ভাবতে মনটা এত গভীরে চলে গিয়েছিল যে চারিপাশের পরিবেশের কোন জ্ঞানই ছিল না। চোখের সামনে সে পাহাড় আর লেকের যায়গাটার দৃশ্যটা হঠাৎ এত জীবন্ত দেখেছিলাম যে মনে হয়েছিল আমি সেখানে এসেছি। কিন্তু সে বড় অল্প সময়ের জন্য। আজ এ নিয়ে দ্বিতীয়বার দেখলাম। গত দুদিন ধরে সামন্তর কাছে আর আবদুলের কাছে এই স্কটিশ জুটওয়ালাদের উশৃঙ্খল বিলাসবহুল জীবন আর অত্যাচারের কাহিনী শুনে, সেগুলো ভেবে ভেবে, ম্যালকমের ওপর একটা প্রতিশোধ স্পৃহার থেকে যে স্বপ্নটার উদ্ভব সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই। রাত প্রায় দেড়টা। নাঃ আজ আর ঘুমাব না। বসে বসেই কাটিয়ে দিই। উঠে আবার একটু কফি বানালাম।

চোখটা খুব জ্বালা জ্বালা করছিল – তাই চোখ বুজে বসে রইলাম। কতক্ষণ জানি না। হঠাৎ কানে এল ‘বাবু’ ‘বাবু’ – চোখ খুলে দেখি ইকবাল – কফি নিয়ে এসেছে। এ কি সকাল হয়ে গেছে – পৌনে সাতটা।

ইকবাল বলল – “আপনি কাল শোন নি বাবু?”

আমি আর কি বলব – ওর প্রশ্ন এড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম –“আবদুল কোথায়?”

– “আবদুল তো বাবু সকালে কলকাতা চলে গেছে – আজ মোতিহারি চলে যাবে”।

কে জানে আবদুলের সাথে হয় তো আর কখনও দেখা হবে না। কিন্তু আমার মনে ও চিরকালই থেকে যাবে।

স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে নিলাম। সাড়ে নটা নাগাদ মিল অফিসে গেলাম মিঃ সোমানির সাথে দেখা করতে। সোমানি নেই – কলকাতা গেছে। কোয়ালিটি কন্ট্রোলে এলাম – যা ব্বাবা সামন্তও নেই – মিঃ সোমানির সাথেই কলকাতা গেছে। প্রদীপ ছিল। আমি ওকে রেসাল্টগুলো পেয়েছি বললাম। ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। সময় আর কাটছে না । কতবার যে ঘড়ি দেখলাম। আর এক মুহুর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না। সাড়ে দশটার সময়ে নকুল এল গাড়ি নিয়ে। জিনিষ পত্র নিয়ে ইকবালকে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ইকবাল তাতেই কত খুশী – বার বার বলল – “আবার আসবেন বাবু”।  

(১০)

এডোয়ার্ড জুট মিলের কাজটা আমার খুব ভাল হয়েছিল। ভাল রিপোর্টও হয়েছিল – রিসার্চ ইভ্যালুয়েশন কমিটির সদস্যরাও খুব প্রশংসা করেছিলেন। মিলে রিপোর্টের কপি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাদের তরফ থেকে কোন জবাব পাই নি। আসলে এই জুটের গবেষণায় দেখেছি – রিসার্চ প্রোজেক্ট দেওয়া হয় – সরকার থেকে প্রোজেক্টের টাকাও আসে – কাজও হয় কিন্তু রেসাল্ট নিয়ে কেউ তেমন একটা মাথা ঘামায় না – ওই রিপোর্ট লিখে সব জায়গায় পাঠানো হয় – বড় জোর গবেষণা পত্র বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশ করা হয়। আমার ডিপার্টমেন্টের হেড আমাকে খুব ভালবাসতেন – আয়ারল্যান্ডের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি থেকে পি এইচ ডি করেছিলেন। একদিন আমাকে হেসে এই প্রসঙ্গে বলেছিলেন – “আমাদের ছোটবেলায় বাংলার টিচার বলতেন –‘আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে, দশানন জয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে – কিন্তু ফল কি হয়েছিল তা’ কোথাও বলা হয় নি’। তা আমাদের জুটেও তাই – এখানে ফল নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না”।      

কেটে গেছে প্রায় বছর দশেক। জুট শিল্পের কোন উন্নতিতো হয়ই নি – বরঞ্চ আরও খারাপের দিকে গেছে। এডোয়ার্ড জুট মিলে আমার আর যাওয়া হয় নি। শুনেছি মেঙ্ঘানি মিল বিক্রি করে দিয়েছিল। তার পর থেকে মিলে প্রায়ই গণ্ডগোল লাগত – বার তিনেক দু মাস চার মাস করে লক আউট হয়ে হয়ে গত চার বছর ধরে একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। মিঃ সামন্তরও কোন খবর আর পাই নি। আছে হয়তো কোন চটকলে। তখন শীতকাল – ক’দিন ছুটিতে ছিলাম। একদিন নিজের একটা কাজে শেক্সপীয়ার সরণিতে অন্ধ্র ব্যাঙ্কের জোনাল অফিসে গিয়েছিলাম। কাজের শেষে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে কড়েয়া রোড দিয়ে যাচ্ছি – পার্ক স্ট্রীট হয়ে মোড় থেকে বাস ধরব। ফুটপাথ ধরে যাচ্ছি – পাশে পাশে টানা লম্বা উঁচু পাঁচিল চলেছে। কাদের যায়গা রে বাবা। বা দিকে রাস্তা বেঁকে গেছে – বেশ কিছু মোটর গ্যারেজ আছে। কিছুটা এগোতে দেখি একটা বড় কালো এস ইউ ভি গাড়ি থেকে জনা চারেক বয়স্ক সাহেব মেম নামল।  সবার হাতেই ফুলের তোড়া – গ্ল্যাডিওলি, ক্রিসেন্থিমাম। নেমে ওই পাঁচিল ঘেরা যায়গাটার তোরণ দিয়ে ঢুকছে। লোহার বড় উঁচু গেট। দু পাশে ঘর – মাঝে এন্ট্রান্স – ওপরে ছাদ। গেটের ভেতর দিয়ে ফাঁকা বিশাল মাঠের মতন দেখা যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে গেলাম। গেটের মাথার ওপরে দেয়ালে লেখা ‘স্কটিশ সিমেট্রি’। ও আচ্ছা এটা তা’ হলে কবরখানা – আসলে এ দিকেতো কখনও আসি নি – জানা ছিল না। সিমেট্রি দেখেছি পার্ক স্ট্রীটে, জগদীশ বোস রোডে আর ছোটবেলায় যখন টালিগঞ্জের দিকে থাকতাম – সেখানে গলফ ক্লাব রোডে। পাশ দিয়ে অনেকবার গেছি কিন্তু ভেতরে ঢুকিনি।   

আজ একটা অদম্য কৌতূহল হল ভেতরে ঢুকে দেখার। অবশ্য বাইরের লোকদের দুমদাম ঢুকতে দেয় কি না জানি না। সাহেব মেমদের দেখে – ভেতর থেকে এক রোগা শ্যামলা, লম্বাটে গোছের ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। মাথার চুলগুলো কাঁচাপাকা, কোঁকড়ান। পঞ্চাশের ওপর বয়সতো হবেই। জিনসের প্যান্ট আর চেক চেক শার্ট পরা। দরজা খুললেন। সাহেবদের সাথে কি কথা হ’ল – আর ভদ্রলোক মাথা নেড়ে ওনাদের ভেতরে যেতে দিলেন। আমার কি মনে হল চট করে গিয়ে ওই ভদ্রলোককে বললাম – “আমি কি ভেতরে যেতে পারি? আমি আগে  কখনও কোন সিমেট্রির ভেতরে আসি নি”। উনি মাথা নেড়ে বললেন – “যান না”। এই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক আর তার স্ত্রী এখানেই থাকেন। সিমেট্রির কাস্টোডিয়ান।

আমি ভেতরে ঢুকে দেখলাম ওই সাহেব মেমরা একটা মনুমেন্টের সামনে সব ফুলের তোড়াগুলো রেখেছে আর মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই এদের পুর্ব্বপুরুষ – ব্রিটিশ আমলে এখানেই থাকত। আমি দেখতে দেখতে  যাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল এক পাশে একটা সমাধি বেদি – ওপরের সাদা পাথরের স্ল্যাবের নিচেরটা একেবারে ভেঙে গেছে। লেখা পড়ে বুঝলাম সমাধিটি শিক্ষাবিদ, মিশনারি রেভারেন্ড লাল বিহারী দের – যার বিখ্যাত বই ‘ফোক টেলস অফ বেঙ্গল’ আর ‘গোবিন্দ সামন্ত’ – যা পরে নাম হয় ‘বেঙ্গল পিসেন্ট লাইফ’। বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আলেক্সান্ডার ডাফের অনুপ্রেরণায় খ্রীষ্টধর্ম গ্রহন করেন। তার পরেই আছে ডাক্তার দ্বারকা নাথ বোসের তিনটি পক্ষের তিন স্ত্রী দূর্গামণি, ফুলমণি এলিজাবেথ মেরি অ্যানি আর মেরি ধনিমণি দাস বসুর বড় পেডাস্টাল টুম্ব।  দ্বারকা নাথ বোস আরও দুজন বাঙালির সাথে  ১৮৪৬ সালে ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জারি থেকে ডাক্তারি পাস করে আসেন।  

পুরো কবরস্থান আস্তে আস্তে দেখতে দেখতে আসছি। কত রকমের টুম্ব বা সমাধি স্তম্ভ – সবই প্রায় ভেঙে ভেঙে পড়েছে। ইট বেরিয়ে, আগাছা জঙ্গলে ভরে আছে। অনেকগুলো আবার শুধুই হেডস্টোন যার মধ্যে নামধাম বা যাকে বলে এপিতাফ অর্থাৎ সমাধিস্তম্ভলিপি লেখা আছে। অনেকগুলো মহিলা আর পুরুষের কবর আছে যাদের ওই পঁচিশ তিরিশ বছর বয়সেই মৃত্যু হয়েছে। বেশ কয়েকটা শিশুর কবরও আছে। প্রায় চারটে বাজে – এবার বেরিয়ে পড়তে হবে না হলে বাসে ভীড়ের ঠেলায় উঠতে পারবনা।     

পাঁচিলের ধার ধরে লাইন দিয়ে পরের পর টুম্ব। পাশ দিয়ে ঘাসে ভরা লম্বা রাস্তা মেন গেটের দিকে চলে গেছে। রাস্তার ডানদিকেও লাইন দিয়ে নানা ধরণের টুম্ব। রাস্তা দিয়ে একটু তাড়াতাড়ি আসছি। এমন সময় বিপত্তি – জুতোর ভেতর একটা বড়সড় কাঁকড় ঢুকেছে। বাধ্য হলাম থামতে। বা পাশে একটা বট গাছ – আর তার মোটা মোটা ঝুড়িগুলো কাণ্ডের গা ঘেঁষে নেমে এসেছে। গাছটা ঘিরে চার পাঁচটা ছোট বড় টুম্ব আর সামনে একটা কফিনের মতন বেদি – ফুটখানেক উঁচু। দাঁত বের করা ইটের গাথনি, আগাছায় ভরা – শ্যাওলা শুকিয়ে কালো হয়ে আছে তার পাশেই মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে জুতোর ফিতে খুললাম। এটা আবার সেই বাটার পাওয়ারের লম্বা ফিতেওয়ালা ওয়াকিং সু। ফিতে আলগা করে জুতো খুলে কাঁকড় বার করে আবার জুতো পড়ে ফিতে বাঁধতে বাঁধতে এমনিই হঠাৎ সামনের কফিন বেদিটার দিকে চোখ পড়তে দেখি পাথরে খোদাই করা লেখা DIED. SEP 28, 1890। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। আসলে এই আঠাশে সেপ্টেম্বরটা আমার কাছে খুব অপয়া দিন বলে কেন জানি না মনে হয়। ঝট করে মাথার মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ ঝলকের মতন নামগুলো বেড়িয়ে গেল – সামন্ত…অ্যালান…আবদুল…ইদ্রিশ… বদ্রীপ্রসাদ…ম্যালকম। অজান্তেই বেদিটার ওপর লেখাটার দিকে নজর গেল। আর সাথে সাথে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা বরফ ঠান্ডা স্রোত যেন বয়ে গেল। সমস্ত শরীরটা অবশ হয়ে গেল এমন কি জুতোর ফিতে বাঁধার শক্তিটাও হারিয়ে গেছে – চোখের সামনে যেন একটা বিশাল শুন্যতা। বেদিটার ওপর লেখা –        

আমি জানি অ্যালানের পূর্ব্ব পুরুষ অত্যাচারি ম্যালকমের কি ভাবে মৃত্যু হয়েছিল। 

♣ ♣ ♣

 

একপর্ণিকা শারদীয়া সংখ্যা (২০১৮) এ প্রকাশিত 

 

Leave a comment