অপার্থিব মেধার সন্ধানে

৯ আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগ

 

আজ সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় রবিবার। আগামী শুক্রবার প্রফেসর মহাকাশ ভট্ট ফিলাডেলফিয়া চলে যাচ্ছেন। আগে ঠিক ছিল সামনের বছর মার্চ্চ-এপ্রিলে ফিরে আসবেন। এখন নিজেই বুঝতে পারছেন না কবে নাগাদ ফিরতে পারবেন। আর আমি যখনই আসি স্যারের সাথে হয় লাঞ্চ নয় ডিনার করতেই হয়। আজকের লাঞ্চে মেনু ছিল পোলাও, মাছের চপ, কষা মাংস, আমসত্ত্বের চাটনি আর কালোজাম মিষ্টি। খেয়েদেয়ে স্যারের স্টাডিতে এলাম। স্যার যথারীতি পাইপ ধরিয়ে রিক্লাইনারে আর আমি ভয়েস রেকর্ডার নিয়ে সোফায় যে যার যায়গায় অধিষ্ঠান হলাম।

স্যার বললেন – “আগের দিন তুমি জানতে চেয়েছিলে যে আন্তঃনক্ষত্র যোগাযোগের জন্য এ পর্য্যন্ত কি ধরণের বার্তা পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছে। যোগাযোগ বিষয়টা উভয় তরফের। আগে আমরা ভিনগ্রহীদের পাঠানো কোন বার্তা গ্রহণ করার নানা প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা করেছি। আজ তাদের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠানোর কি কি পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি তাই নিয়ে আলোচনা করব। বহির্বিশ্বে মেধাবী প্রাণী আছে কি না এই নিয়ে তত্ত্বতালাশ করাকে আমরা যেমন ইংরেজিতে বলি SETI বা Search for Extraterrestrial Intelligence তেমনি তাদের সাথে যোগাযোগের উপায় নির্ধারণ করার পদ্ধতি উদ্ভাবনের বিবিধ গবেষণাকে একসাথে বলা হয় CETI অর্থাৎ Communication with Extraterrestrial Intelligence। CETI অবশ্য SETI-রই একটা শাখা। বহির্বিশ্বের অন্যান্য প্রযুক্তিগত আমাদের মতন বা তার চেয়েও বেশি উন্নত সভ্যতার সাথে যোগাযোগের জন্য আর তারা যাতে পাঠোদ্ধার করতে পারে এরকম কিছু সাংকেতিক বার্তা কি ভাবে রচনা করা ও পাঠানো যায় ও তাদের পাঠানো বার্তা উদ্ধার করা যায় – সে বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি নিবদ্ধ করাই CETI-র অন্তর্গত বিবিধ গবেষণা প্রকল্পগুলির কাজ। এ বিষয়টাকে একসময়ে অনেকে বলত exosemiotics। এরকমই আরেকটি হচ্ছে METI (Messaging Extraterrestrial Intelligence)। METI International বা সংক্ষেপে METI বছর পাঁচেক আগে প্রতিষ্ঠিত ক্যালিফোর্ণিয়ার সানফ্রানসিস্কো শহরের একটি গবেষণা কেন্দ্র যার উদ্দেশ্য মেধাবী ভিনগ্রহীদের জন্য উপযুক্ত আন্তঃনক্ষত্র বার্তা লেখা আর পাঠানো।

CETI-র বর্তমান গবেষণা চারটি বিস্তৃত বিষয়ে সীমাবদ্ধ – ১) গাণিতিক ভাষা, ২) ছবির ভাষা, ৩) অ্যালগোরিদম অর্থাৎ সফটওয়্যার প্রোগ্রাম যেমন অনুক্রমে লেখা হয় – সে রকম যোগাযোগ সিস্টেম আর ৪) যেমন প্রাচীন শিলালিপি ব্রাহ্মি, খরোষ্ঠি, হিয়েরোগ্লিফস বা মিশরীয় ভাষা উদ্ধার করা হয়েছে ঠিক তেমনভাবে কোন এক স্বাভাবিক ভাষার লেখার পদ্ধতি তৈরী করা – যা কি না কম্পিউটারের সাহায্যে চিহ্নিত-করণ ও পাঠোদ্ধার করা যায়। আমরাও কিন্তু মহাকাশ থেকে অবিরত আসা রেডিও তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে দেখার চেষ্টা করছি কোন ভিনগ্রহী ভাষার সংকেতের পাঠোদ্ধার করা যায় কি না। যেমন তোমাকে আগে একবার WOW সিগন্যালের কথা বলেছিলাম।

ধরতে গেলে উনবিংশ শতাব্দী থেকেই ভিনগ্রহীদেরকে আমাদের অস্তিত্ব জানানোর চেষ্টা শুরু হয়েছিল। তখন অবশ্য আমাদের ধারণার দৌড় চাঁদ, শুক্র আর বড় জোর মঙ্গল গ্রহ অব্ধি ছিল। নানা রকম প্রস্তাব করা হয়েছিল যেটা এখন খুব মজাদার বলেই মনে হবে। যেমন একটা প্রস্তাব ছিল ১৮১৯ সালে বিখ্যাত জার্মান গণিতজ্ঞ ও পদার্থবিদ কার্ল ফ্রেডরিখ গসের। সাইবেরিয়ার তুন্দ্রা অঞ্চলের বিস্তির্ণ এলাকার জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে দশ মাইল চওড়া পাইন গাছের বর্ডার করে তিনটে চতুর্ভূজ ও মাঝে একটা ত্রিভূজকে সাজাতে হবে আর মাঝে গম বা রাইয়ের ক্ষেত থাকবে যা’তে চাঁদের থেকে দেখলে পিথাগোরাসের থিওরেমের প্রমাণের মতন ছবিটা মনে হয় আর সেখানকার লোকেরা বুঝতে পারবে যে পৃথিবীর লোকেরাও অঙ্ক জানে। ঐ সময়ে অস্ট্রিয়ান জ্যোতির্বিদ জোসেফ ফন লিট্রো প্রস্তাব দেন সাহারা মরুভূমিতে কয়েকশ গজ চওড়া আর কুড়ি মাইল ব্যাসের খাল কেটে তাতে জল আর কেরোসিন দিয়ে আগুন জ্বালাতে হবে প্রত্যেক রাত্রিতে যা’তে চাঁদের লোকেরা বুঝতে পারে আমাদের জ্যামিতির জ্ঞান আছে। ১৯২০ সাল নাগাদ আলোর ফ্ল্যাশ দিয়ে মোর্স কোডের আদলে সংকেত পাঠানোর কথাও ভাবা হয়েছিল। অবশ্য এর কোনওটাই কোনওদিন বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করা হয় নি। ১৯০০ সাল নাগাদ এক লক্ষ ফ্রাঁ-র গুজম্যান পুরস্কার ঘোষনা করা হয়েছিল মঙ্গলগ্রহ বাদে সর্ব্বপ্রথম আন্তঃগ্রহ যোগাযোগের উপায় আবিষ্কার করতে পারার জন্য।

বিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকের কাছাকাছি এসে বৈজ্ঞানিকরা এটুকু বুঝে গিয়েছিলেন যে অন্তত আমাদের এই সৌরমন্ডলে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও মানুষ নেই। আগে তোমাকে বলেছিলাম যে ১৯৫৯ সালে অধ্যাপক ফিলিপ মরিসন আর জিউসেপি ককোনি প্রস্তাব দেন যে বহির্বিশ্বে উন্নত মেধার সন্ধানের জন্য কোন সংকেত পাঠানোর সবচেয়ে ভাল মাধ্যম তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ – বিশেষ করে অতি উচ্চ কম্পাঙ্কের রেডিও তরঙ্গ। ইংল্যান্ডের ‘নেচার’ পত্রিকায় তাঁদের গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশের সাথে সাথে ভিনগ্রহীদের সাথে যোগাযোগের এক নতুন দিগন্ত খুলে যায় এবং বিজ্ঞানীরা বিবিধ পদ্ধতি উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় উঠে পড়ে লেগে যান। গড়ে ওঠে মহাকাশ গবেষণার এক নতুন বিষয় – SETI। একদিকে যেমন রেডিও টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাকাশ থেকে ভিনগ্রহীদের পাঠানো কোন ধরণের সংকেত ধরার প্রচেষ্টা চলতে থাকে – তেমনি পাশাপাশি কি ধরণের সাংকেতিক বার্তা পাঠালে উন্নত মেধার ভিনগ্রহীরা আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পারে তারও অনুসন্ধান চলতে থাকে।

যে কোন প্রাণীর মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হ’ল ভাষা আর তা’ হয় তিন প্রকারে – কথা বলে, লিখে আর “যাহা বিনি ভাষায় উক্ত” অর্থাৎ শরীরী ভাষায় আর প্রতীক বা ইশারার ভাষায়। প্রতিটি জাতের প্রাণীর নিজস্ব ভাষা আছে। পৃথিবীতে নানান জাতের মানুষের নানান ভাষা যাকে বলি স্বাভাবিক ভাষা (Natural Language) যেমন আমাদের বাংলা, হিন্দি, ইংরেজী, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, চীনে, জাপানি কত আর বলব। সারা পৃথিবীতে বর্তমানে সাত হাজারেরও বেশি ভাষা আছে আর উপভাষা বা ডায়ালেক্ট যে কত আছে তার হিসেব জানি না।

এখন স্বাভাবিক কারণেই কোন স্বাভাবিক ভাষা সার্বজনীন ভাষা হয়ে উঠতে পারে নি। প্রচেষ্টা যে হয় নি তা’ নয়। তুমি এস্পেরান্ত-র নামতো শুনেইছো। ১৮৮৭ সালে পোল্যান্ডের এক চোখের ডাক্তার ও ভাষাবিৎ লুডউইক যামেনহফ এটি আন্তর্জাতিক ভাষা রূপে যাতে গড়ে উঠতে পারে তার জন্য গঠন করেন। বুঝতেই পারছ এটি কোন স্বাভাবিক ভাষা নয়, বিরচিত ভাষা। তবে এখনও পর্যন্ত কোন দেশই একে দ্বিতীয় ভাষা রূপে সরকারি স্বীকৃতি দেয় নি। এটি আজও ঐ কেতাবী আগ্রহতেই সীমাবদ্ধ আছে।

তবে গণিতওতো একপ্রকার ভাষা – মনের ভাব সংখ্যার সাহায্যে প্রকাশ করতে গেলে গণিতই মাধ্যম। গাণিতিক ক্রিয়াপদ্ধতিগুলি সার্বজনীন হলেও সংখ্যাগুলোতো স্বাভাবিক ভাষাতেই লেখা। তাই মনের ভাবপ্রকাশের জন্য এমন একটা কৃত্রিম সাংকেতিক ভাষার সৃষ্টি করতে হবে যা একটু চেষ্টাচরিত্র করলে পাঠোদ্ধার করা যায়। সে ভাষা দিয়ে হয়তো ভিনগ্রহীদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে।

এটা ঠিকই মহাকাশে ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠাতে গেলে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমেই পাঠাতে হবে। সুতরাং যে কৃত্রিম ভাষা তার জন্য তৈরী করতে হবে তা যাতে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো যায় সেটা সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। তাই এ জাতীয় ভাষার নাম দেওয়া হয়েছে রেডিওগ্লিফস – মিশরীয় ভাষার অনুকরণে বা অনুসরণে যেটা খুসী বলতে চাও বল। ১৯৬০ সালে হান্স ফ্রয়ডেনথাল নামে এক ডাচ গণিতজ্ঞ Lincos: design of a language for cosmic intercourse, Studies in logic and the foundations of mathematics নামে একটা বই লেখেন যেখানে গণিত, লজিক চিহ্ন ইত্যাদি মিলিয়ে একটা মহাজাগতিক ভাষা কিরূপ হতে পারে তার একটা আভাষ দেন। Lincos কথাটা নিয়েছেন ল্যাটিন কথা lingua cosmica থেকে যার মানেতো সহজেই বুঝতে পারছ। এই লিনকোস ভাষা তিনি এমনভাবে তৈরী করেছিলেন যে এতে লেখা কোনও বার্তা রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে মহাকাশে পাঠানো যায় আর তা’ যে কোনো আমাদের মতন উন্নত মেধার ভিনগ্রহী প্রাণী সে বার্তা গ্রহণ করে পাঠোদ্ধার করতে পারে। তবে সমস্যা হল এই লিনকোসে কোন লেখা পাঠাবার আগে এর একটা অভিধান পাঠাতে হবে যাতে ক্রমান্বয়ে পাঠানো বিবিধ ধরণের রেডিও পালসের সাথে অখণ্ড সংখ্যা ও বিবিধ গাণিতিক চিহ্নগুলি কি ভাবে সংশ্লিষ্ট বোঝা যায়।

বেশ কয়েক দশক ধরে লিনকোস কেবল তাত্ত্বিক আগ্রহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল – এর কোন ব্যবহারিক প্রয়োগ করা হয় নি। অবশেষে ১৯৯৯ সালে কানাডার দুই জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ইভান ডুটিল ও স্তেফান ডুমাস অপার্থিব সভ্যতার সাথে যোগাযোগের উদ্দেশ্যে এক শব্দ নিরোধক কোডিং সিস্টেম উদ্ভাবন করেন এবং লিনকোসে সেই কোডে বার্তা লিখে কৃষ্ণসাগরের তীরে ইউক্রেনের বন্দর শহর ইয়েভপাতোরিয়ার RT70 রেডিও টেলিস্কোপ থেকে কাছাকাছি কিছু তারার উদ্দেশ্যে পাঠান। এই প্রোজেক্টের নাম ছিল ‘কসমিক কল’। আবার ২০০৩ সালে, কাছাকাছি আরও কিছু তারার উদ্দেশ্যে এ ভাবে বার্তা পাঠানো হয়েছিল। এইসব বার্তা ছিল কয়েক পাতার প্রাথমিক স্তরের অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত।

ল্যান্সলট হগবেন ছিলেন বৃটিশ জুলজিস্ট। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার আন্তর্জাতিক ব্যবহৃত শব্দকোষের সাহায্য নিয়ে তিনি একটি ‘ইন্টারগ্লসা’ নামে এক নতুন ভাষা গঠন করেছিলেন খুব সহজ ব্যাকরণ ও ৮৮০ টা শব্দের সাহায্যে। ১৯৫২ সালে তিনি বৃটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটরি সোসাইটির এক অধিবেসনে ‘অ্যাস্ট্রাগ্লসা’ (Astraglossa or First step in celestial syntax) শিরোনামে কি ভাবে তাঁর উদ্ভাবিত ভাষা ব্যবহার করে মহাকাশে রেডিও বার্তা পাঠানো যেতে পারে সে সম্বন্ধে আভাষ দিয়েছিলেন।

আচ্ছা তুমি কি কার্ল সাগানের ‘কনটাক্ট’ বইটা পড়েছ? এটা একটা সাইন্স ফিকশন বা এখন যাকে বাংলায় বলে কল্পবিজ্ঞান।?”

আমি বললাম – “নাম শুনেছি তবে পড়া হয় নি”।

স্যার উঠে গিয়ে সামনের বইয়ের র‍্যাক থেকে বইটা বার করে আমায় দিয়ে বললেন – “এই বইটা তোমার কাছেই রাখো। পড়ে দেখবে। এটা একটা হার্ড সাইন্স ফিকশন যেখানে আগামী অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কথা বলা হলেও তার মধ্যে যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও প্রয়োগের সম্ভাব্য বাস্তবতা থাকে। এমন কোন উদ্ভট বিষয় থাকে না যা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ অবাস্তব। যাই হোক সাগান ১৯৮৫ সালে এই বইটাতে মৌলিক সংখ্যা দিয়ে সুরু করে বিজ্ঞান ও গণিতের বিবিধ সুত্র ব্যবহার করে ভিনগ্রহীদের সাথে যোগাযোগের বার্তা কি রকম হতে পারে সে সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করেছেন। এর আগে ১৯৭৩ সালে সাগান একটি বইয়ের সম্পাদনা করেন সেখানেও তিনি এ বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। এই বইটা ১৯৭১ সালে সোভিয়েত আর্মেনিয়ায় অনুষ্ঠিত Communication with Extraterrestrial Intelligenceএর ওপর একটি কনফারেন্সে পঠিত সব গবেষণা পত্রের সংকলন।

কার্ল ডেভিটো ও রিচার্ড অহর্লে ১৯৯২ সালে লিনকোস আর অ্যাস্ট্রাগ্লসার মতন বাক্য-গঠন পদ্ধতি অনুসরণ করে একটি গঠিত ভাষার প্রস্তাব দেন যেখানে শব্দতালিকা পদার্থের প্রচলিত ভৌতধর্মের মধ্যে সীমিত। ২০১০ সালে ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির মাইকেল বুশ একটি সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বাইনারি ল্যাঙ্গুয়েজ অর্থাৎ ০ আর ১ এর সমন্বয়ে তৈরী করেন যা ‘লোন সিগন্যাল’ নামে একটা প্রোজেক্টে ২০১৩ সালে ১৭.৬ আলোকবর্ষ দূরে বুটিস নক্ষত্রমন্ডলের গ্লাইস৪৪৫(HD119850) তারা লক্ষ্য করে পাঠানো হয়েছে। আশা করা যায় ২০৩১ সাল নাগাদ লক্ষ্যে পৌঁছোবে। ধরা যাক সত্যিই সেখানে কোন উন্নত মেধার প্রাণী তা’ পেয়ে পাঠোদ্ধার করে আমাদের আবার উত্তর পাঠাল – তা’ আমাদের পেতে পেতে ২০৪৮ সালের শেষার্ধ।

এ কথা ঠিক যে লেখার ভাষার থেকে ছবির ভাষা অনেক ক্ষেত্রে বেশী শক্তিশালী, মর্মস্পর্শী ও নান্দনিক। আদিম মানুষ লিখতে শেখেনি কিন্তু ছবি আঁকতে শিখেছিল। ছত্রিশ হাজার বছর আগে স্পেনের আলতামিরার বাইসনের ছবি বা প্রায় দশ হাজার বছর আগের আমাদের মধ্যপ্রদেশের রাইসেন জেলার ভীমবেটকার গুহাচিত্রগুলো গুহামানবদের জীবনের অনেক কথাই বলে। আর ছবির ভাষা কিন্তু সার্বজনীন। তাই মহাকাশে ভিনগ্রহীদের কাছে আমাদের বার্তা পাঠানোর জন্য ছবির যে একটা খুব বড় ভূমিকা আছে এটা বিজ্ঞানীরা বুঝেছিলেন। যে কোন ছবির বিটম্যাপ তৈরী করে সহজে পাঠানো যায়।

এর আগে তোমাকে পায়োনিয়ার ১০, ১১, ভয়েজার ১, ২ আর নিউ হরাইজন স্পেসক্র্যাফট সম্বন্ধে বলেছিলাম। এরা সব সৌরমন্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে মহাকাশে কোন কারণে ধ্বংস না হওয়া পর্য্যন্ত অনন্তকাল চলতে থাকবে। বিজ্ঞান বিষয়ক সাংবাদিক এরিক বার্জেসের উদ্যোগে আর কার্ল সাগান ও ফ্রাঙ্ক ড্রেকের প্রচেষ্টায় তিন সপ্তাহের মধ্যে নয় ইঞ্চি লম্বা আর ছয় ইঞ্চি চওড়া একটা অ্যালুমিনিয়ামের ওপর সোনার প্লেটিং করা এই ১২০ গ্রাম ওজনের ফলকের ওপর সাগানের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী লিন্ডা সাগানের আঁকা ছবি খোদাই করে পায়োনিয়ার ১০-এর অ্যান্টেনার সাথে লাগিয়ে পাঠানো হয়েছিল”।

 

স্যার এই বলে ওনার আইপ্যাড নিয়ে গুগল সার্চ করে পায়োনিয়ার ফলকটা দেখিয়ে বললেন – “ছবিটার ওপরের বাঁ দিকের ছবিটাতে হাইড্রোজেন পরমাণুর হাইপার ফাইন স্ট্রাকচার বোঝান হয়েছে। তার ঠিক নীচে আছে পালসার ম্যাপ। এখানে একটা উৎস থেকে পনেরোটা লাইন বেরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে চোদ্দটা লাইনের তুলনামূলক দৈর্ঘ্য বোঝাচ্ছে উৎস থেকে চোদ্দটা পালসার বা নিউট্রন তারা কত দূরে আছে আর তাদের ঘূর্ণন কম্পাঙ্ক বাইনারি নম্বরে বোঝান হয়েছে। আর একটা লাইন সোজা ডানদিকে চলে গেছে আমাদের সূর্য্য গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে কতটা দূরে তা দেখানোর জন্য। ভিনগ্রহীরা যদি আমাদের মতন নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যায় ও বাইনারি ল্যাঙ্গুয়েজে উন্নত হয় তবে তাদের এটা বোঝা উচিৎ। ডানদিকে একটি পুরুষ ও মহিলা আর তাদের পেছনে পাইয়োনিয়ার স্পেসক্র্যাফটের নকশা। নীচে আমাদের সৌরমন্ডলের সূর্য ও ন’টা গ্রহ আর আমাদের পৃথিবী থেকে যে স্পেসক্র্যাফটটা পাঠানো হয়েছে তা তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে।

এর পরে যখন ১৯৭৭ সালে ভয়েজার ১ আর ২ পাঠানো হ’ল তখন তাদের সাথে দুটো করে ফোনোগ্রাফ রেকর্ড পাঠানো হয়েছিল। এই রেকর্ডগুলিকে বলা যেতে পারে ‘টাইম ক্যাপসুল’। এতে করে ভিনগ্রহীদের কাছে পৃথিবীর গল্প শোনান হয়েছে। এই রেকর্ডগুলো ১২ ইঞ্চি ব্যাসের সোনার গিলটি করা তামার ডিস্ক। এর মধ্যে পৃথিবীর মানুষের বৈচিত্রময় জীবন ও সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে। কার্ল সাগানের নেতৃত্বে গঠিত এক কমিটি এর বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন। ১১৫ টি নানাবিধ ছবি ছাড়া, বিভিন্ন রকম শব্দ – বাতাসের, বজ্রপাতের, পাখি ও অন্যান্য কিছু প্রাণীর ডাক, কিছু সঙ্গীত আর সেই সুমেরীয় থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন দেশের পঞ্চান্নটি ভাষায় শুভেচ্ছা জানানো হয়েছে। অ্যামেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার ও ইউনাটেড নেশনস-এর সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ কার্ট ওয়াল্ডহাইমের বাণীও ছিল। যদিও পাইয়োনিয়ার বা ভয়েজার কোন ভিনগ্রহী লক্ষ্য করে যাবে না তবুও যদি কোনক্রমে কোনও ভিনগ্রহীর নজরে আসে। কার্ল সাগানের কথায় মহাসাগরে বোতলে বার্তা পুরে ফেলে দেওয়া হ’ল – যদি কেউ কখনও হাতে পায়। রেকর্ডগুলি অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ইউরেনিয়াম ২৩৮ এর ইলেক্ট্রোপ্লেটিং করা কভারের ভেতর ছিল। আর কভারের ওপর ছবির মাধ্যমে নির্দেশ ছিল কিভাবে রেকর্ড থেকে পাঠোদ্ধার করতে হবে।

ইতিপূর্বে ১৯৭৪ সালে মনুষ্যজাতি ও পৃথিবী সম্বন্ধে কিছু প্রাথমিক তথ্য দক্ষিণ অ্যামেরিকার উত্তরে ক্যারিবিয়ান সাগরে অবস্থিত পুয়ের্তো রিকো দ্বীপের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন অ্যারিসিবো রেডিও টেলিস্কোপ থেকে পাঠানো হয়েছিল আমাদের থেকে প্রায় ২১০০০ আলোকবর্ষ দূরে গুচ্ছ তারাস্তবক বা গ্লোবিউলার ক্লাস্টার M13-র উদ্দেশ্যে। এটা ঠিক ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্যে কোন শুভেচ্ছা বার্তা নয় – পৃথিবীর মানুষ বিজ্ঞান ও কারিগরিতে কতটা উন্নতি করেছে তার একটা আভাষ দেবার ইঙ্গিত। এই বার্তা ‘অ্যারিসিবো মেসেজ’ নামে পরিচিত আর এটাও ফ্রাঙ্ক ড্রেক ও কার্ল সাগানের যৌথ উদ্যোগ। এটি ৭৩ টি রো ও ২৩ টি কলাম ম্যাট্রিক্সের বিটম্যাপ যাতে আছে সাতটি ভাগে এক থেকে দশ অবধি সংখ্যা, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন, নাট্রোজেন আর ফসফরাসের অ্যাটোমিক নম্বর, সুগার ও কিছু নিউক্লিয়োটাইডের ফরমুলা, ডি এন এ র কাঠামো, একটা মানুষের ছবি – তার গড় উচ্চতা ও বিশ্বের জনসংখ্যা, আমাদের সৌরমন্ডল আর এই বার্তা কোন গ্রহ থেকে আসছে আর অ্যারিসিবো রেডিও টেলিস্কোপের ছবি।

এ ছাড়া রাশিয়ান বিজ্ঞানী আলেক্সান্ডার যাইতসেভের পরামর্শে ইয়েভপাতোরিয়ার RT70 রেডিও টেলিস্কোপ থেকে ২০০১ সালের অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে ছয়টি সূর্য-সদৃশ তারার দিকে ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠানো হয়েছিল। এতে ছিল কিছু ছবি, শুভেচ্ছা বার্তা আর যন্ত্রসঙ্গীত। এই বার্তার বিষয়বস্তু আর কোন তারাদের উদ্দেশ্যে পাঠানো হবে তা’ নির্বাচন করেছিল রাশিয়ার চারটি শহরের কিছু কিশোর বয়সী ছেলেমেয়ে। এ কারণে এই বার্তার নাম ‘টিন-এজ ম্যাসেজ’।

যদিও এই সব পাঠানো বার্তার যদি কোন উত্তর সত্যিই আসে তার সময় এখনও ঢের দেরি। বিজ্ঞানীরা অবশ্য তার জন্য হাত পা গুটিয়ে বসে নেই। নানাবিধ প্রচেষ্টা চলছে। গত তিরিশ বছরে কম্পিউটারের কি হার্ডওয়্যার কি সফটওয়্যারের অকল্পনীয় উন্নতি হয়েছে। তাই বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারাও সেই তাল মিলিয়ে পাল্টাচ্ছে। CETI-র গবেষণার এক নতুন ক্ষেত্র এখন ‘অ্যালগরিদম কমিউনিকেশন সিস্টেম’। এখানে সেই লিনকোসের মতন গাণিতিক ভাষা আর কিছু সাধারণ লজিক চিহ্ন নিয়ে একটা প্রাথমিক স্তরের প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ তৈরী করা হবে যা ভিনগ্রহী গ্রাহক কোন ভারচুয়াল মেশিনে চালাতে পারবে। এ রকম আরেকটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম ‘কসমিক ওএস’ (Cosmic OS) তৈরী করেছিলেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনলজির পল ফিটজপ্যাট্রিক। ল্যাম্বডা ক্যালকুলাসের ওপর ভিত্তি করে এই প্রোগ্রাম তৈরী করতে চারটি প্রাথমিক সিম্বল নেওয়া হয়েছিল – দুটো বাইনারি সংখ্যা ০ ও ১ আর প্রথম ব্র্যাকেটের দুটি চিহ্ন। ব্রিয়ান ম্যাককোনেল তৈরী করেছেন একট ভারচুয়াল মেশিন – ‘লজিক গেট ম্যাট্রিসেস’ (Logic Gate Matrices LGM)।

CETI গবেষণায় বর্তমানে আর একটি ক্ষেত্র নিয়ে চেষ্টা চলছে তা’ হ’ল স্বাভাবিক ভাষার বার্তা। বর্তমানে স্বাভাবিক ভাষার প্রক্রিয়াকরণ বা Natural Language Processing নিয়ে যথেষ্ট কাজ চলছে যা Artificial Intellegence এর একটি শাখা। ইংল্যান্ডের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের জন ইলিয়ট ও এরিক অ্যাটোয়েল এই নিয়ে কিছু কাজ করেছেন। রেডিও ওয়েভের মাধ্যমে আমরা বার্তা পাঠিয়ে থাকি আবার গ্রহণ করেও থাকি। এটাতো আর আশা করতে পারি না যে ভিনগ্রহীরা তাদের বার্তা আমাদের কাছে ইংলিশ বা বাঙলা বা ফ্রেঞ্চ-জার্মানি ভাষায় পাঠাবে। তাদের ভাষা নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ আলাদা যা হয়তো আমাদের পৃথিবীর কোনও ভাষার সাথে মিলবে না। তাদের হরফতো কিছুই বোঝা যাবে না। কিন্তু প্রাচীন পৃথিবীর লুপ্ত হয়ে যাওয়া অনেক ভাষাইতো আমাদের জানা ছিল না। জানা ছিল না তাদের হরফ, লেখার পদ্ধতি যা পাথরের দেওয়ালে, পাথরের বা মাটির ট্যাবলেটে, মুদ্রায় পাওয়া গেছে। যদিও কিছু কিছু প্রাচীন লেখা যেমন আসিরিয়-ব্যাবিলনীয় সভ্যতার সুমেরু-আক্কাডিয়ান কিউনিফর্ম, ইজিপ্টশিয়ান সভ্যতার হায়ারোগ্লিফস বা আমাদের ব্রাহ্মি-খরোষ্ঠিতে লেখা অশোকের শিলালিপির পাঠোদ্ধার করা গেছে। কয়েক দশক ধরেই কম্পিউটারের সাহায্যে ভাষাতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে ন্যাচারেল ল্যাঙ্গোয়েজ প্রসেসিং সফটওয়্যার উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আংশিক সাফল্যও এসেছে স্পিচ সিন্থিসিস ও স্পিচ রেকগনিশন, অনুবাদ, ব্যাকরণ ও বানান সংশোধন ইত্যাদি।

যদি ভিনগ্রহীরা রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে আদৌ কোন বার্তা আমাদের পাঠিয়ে থাকে তাদের ভাষায়, সেটা আমাদের কাছে অজানা সাংকেতিক লিপি – আর তার পাঠোদ্ধার করতে হবে। সুতরাং এমন এক কম্পিউটার প্রোগ্রাম উদ্ভাবন করতে হবে যা সেই ভাষাকে বিশ্লেষণ করে দেখবে সেখানে ভাষার আদৌ কোন কাঠামো আছে কি না। তার পরে তার হরফ, বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া সব সনাক্ত করতে হবে। এখন সব ভাষারই নির্দিষ্ট শব্দকোষ থাকে আর বাক্যগঠনে শব্দগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট সম্পর্ক থাকে। যদি এই জাতীয় প্রোগ্রাম আমাদের পৃথিবীর নানা ভাষা বিশ্লেষণ করে কোন সাধারণ প্যাটার্ন বার করতে পারে তবে তা দিয়ে অচেনা অজানা ভিনগ্রহীদের ভাষারও পাঠোদ্ধার করতে পারবে।

একদিকে যেমন ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্যে কি ভাবে বার্তা পাঠানো যায় তার গবেষণা চলছে, অপর দিকে আবার কিছু বিজ্ঞানী ও সমাজ বিজ্ঞানী এর বিরুদ্ধেও বক্তব্য রাখছেন। ক্যালিফোর্ণিয়ার SETI Instituteএর নামকরা বরিষ্ঠ গবেষক জ্যোতির্বিদ ও রেডিও-টেলিভিশন জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব শেঠ শোস্তাক, জার্মানীর মাইকেল হিপকে, হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন লার্নেড ও আরও অনেক বিজ্ঞানী এ বিষয়ের ভালোমন্দ নিয়ে অনেক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। মোটামুটি তাঁদের বক্তব্য এই যে আমরা বহির্বিশ্বে মেধাবী প্রাণীর সন্ধানে নানারকম বার্তা পাঠাচ্ছি বা তাদের পাঠানো কোন বার্তা খুঁজে পাওয়া কি না তার প্রচেষ্টা চালাচ্ছি – এটা করা কতটা ঠিক হচ্ছে কারণ এতে একটা বিপদের ঝুঁকি অতি অবশ্যই থেকে যাচ্ছে। এতে আমাদের বহির্বিশ্ব সম্বন্ধে হয়তো অনেক জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে পারে বটে কিন্তু তার সাথে সাথে আমাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হতে পারে”।

আমি স্যারের কথাটা ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম – “কেন স্যার?”

স্যার বললেন – “দেখ প্রাগঐতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ আগ্রাসন নীতি অনুসরণ করে এসেছে। মনে হয় এটা মানুষের একটা প্রবৃত্তি – সবার না হলেও কিছুজনেরতো বটেই বিশেষ করে যদি ক্ষমতাবান হয়। অপরের ওপর আধিপত্য বিস্তার ক্ষমতার অপব্যবহার থেকেই আসে। আদিম যুগে গোষ্ঠীদ্বন্দ লেগেই ছিল। জয়ী জাতি পরাজিতদের নিঃশেষে কোতল করত। পরবর্ত্তী যুগে রাজাদের রাজ্যজয় করে সাম্রাজ্য বাড়ান নেশার মতন ছিল। এভাবেই গড়ে উঠেছিল মৌর্য সাম্রাজ্য, রোমান সাম্রাজ্য, গুপ্ত বা মোগল সাম্রাজ্য – ইতিহাসের একটা বড় অংশই এই রাজত্ব বিস্তার। চিন্তা করোতো প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কি প্রয়োজন ছিল? এখনও যুদ্ধ করে না হোক, অর্থনৈতিক ভাবে আগ্রাসন ঠিকই চলছে।

সুতরাং ইতিহাসের প্রাচীন অভিজ্ঞতা থেকে মানুষের মনে এই ধারণা আসা স্বাভাবিক যে যদি কোন ভিনগ্রহী প্রাণী আমাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানতে পারে তবে নির্ঘাৎ আমাদের ওপর কোন আঘাত হানার চেষ্টা করবে ও পৃথিবীতে মানুষের জীবনে বিপদ নেমে আসতে পারে। যদিও কোন ভিনগ্রহীর সন্ধান এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায় নি আর তাদের আমাদের পৃথিবীতে আসার সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে প্রায় নেই বলতে পারি কিন্তু আতঙ্কটা মানুষের মনে রয়েই যায়। আর সে ভাবনা থেকেই দেখ সেই এইচ জি ওয়েলসের ওয়ার অফ দা ওয়ার্ল্ডস থেকে আজ পর্যন্ত সিংহভাগ কল্পবিজ্ঞানের বই বিশেষ করে যত হলিউডের সিনেমা সব অতি অদ্ভূত বা উদ্ভট দর্শনের ভিনগ্রহীদের সাথে যুদ্ধ-মারদাঙ্গার কাহিনী। আমাদের সন্ধান পেয়ে গ্রহান্তরের কোন মহাত্মা সশিষ্য পৃথিবীতে শান্তির ললিত বাণী শুনাতে এসেছেন – এরকম কোন কল্পবিজ্ঞান আমি অন্তত পড়ি নি।

তাই অনেক বিজ্ঞানী, সমাজত্তত্ববিদ ও অন্যান্য ব্যক্তিত্ব আমাদের এই আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রচেষ্টার বিপক্ষে কথা বলেন। এমন কি প্রখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থবিদ স্টিফান হকিংও আমাদের চেয়েও উন্নত ভিনগ্রহী সভ্যতা থেকে যে পৃথিবীতে বিপদ আসতে পারে সে বিষয়ে বার বার সাবধান করেছিলেন। এ জাতীয় সভ্যতা হয়ত যুদ্ধপ্রিয় জাতির মতন অন্য গ্রহে উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য আক্রমণ করতেই পারে। অথবা প্রথমে ভালমানুষের মতন অতিথি হয়ে এসে পরে স্বরূপ প্রকাশ করতে পারে। কলম্বাস, পিজেরো বা আমাদের বৃটিশ জাতির ইতিহাসতো জানাই আছে তোমার। ভাল শান্তিপ্রিয় ভিনগ্রহীও থাকতে পারে আবার যুদ্ধবাজ ভিনগ্রহীও থাকতে পারে। কোনওটাই আমরা জানি না।

দেখো গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে যখন এই বহির্বিশ্বে মেধার সন্ধান শুরু হয়েছিল তখন নিঃসন্দেহে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মতন ব্যাপারই ছিল। কিন্তু এখন আমরা অনেক বাসযোগ্য অসৌরগ্রহের সন্ধান পেয়েছি। আমাদের এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে কয়েকশ কোটি গ্রহ থাকা বিচিত্র নয়। তাই ভবিষ্যতে ঝাঁকে ঝাঁকে আরও পাওয়া যাবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর সে সব গ্রহের মধ্যে দু’একটার মধ্যে যে আমাদের থেকেও উন্নত সভ্যতা নেই তা’ কে বলতে পারে। সে রকম উপযুক্ত সম্ভাবনা বিচার করে তাদের দিকে তাক করে বার্তা পাঠানো যেতে পারে। তবে অনেকের মতে সেটা কতটা সমীচীন তা বিচার্য। নির্জন বন্য প্রাণীতে ভরা জঙ্গলে চিৎকার করে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়া কি খুব বুদ্ধিমানের কাজ?

আমি বললাম – “কিন্তু স্যার এতদিন আপনি যা বলেছেন তা’তে এটাই মনে হয় যে কোনও ভিনগ্রহী যদি আমাদের খোঁজও পায় মহাকাশের এই অকল্পনীয় দূরত্ব পেরিয়ে দলে দলে এসে আক্রমণ করবে এটা ভাবাটাওতো একটা ফ্যান্টাসি”।

স্যার – “তারা যে সব সশরীরে যুদ্ধজাহাজের বিশাল বহর নিয়ে আসবে তা’ তোমায় কে বলল। তারা তাদের গ্রহে বসেই আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করতে পারে”।

– “তা’ তো ঠিক বুঝলাম না স্যার। সেটা কি ভাবে সম্ভব?”

স্যার – “এই যে প্রায়ই দেখ লোকের ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা কারা তুলে নিয়েছে। হয়তো তোমাকে ধোঁকা দিয়ে তোমার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে কিংবা তোমার কম্পিউটার হ্যাকিং করে তোমার তথ্য সব জেনে নিয়ে কান্ডটি ঘটিয়েছে। অনেক অরক্ষিত ওয়েবসাইট আছে যেটা অজান্তে ঘাটতে গিয়ে বা ডাউনলোড করতে গিয়ে অনেক ধরণের ভাইরাস তোমার কম্পিউটার সিস্টেমে ঢুকে পরে নানারকম ক্ষতি করতে পারে। তোমার প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নষ্ট করে দিতে পারে। কোনও ট্রোজান তোমার অপারেটিং সিস্টেমে ঢুকে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে একসময়ে তোমার অজান্তে পুরো সিস্টেমটাই একেবারে ভেঙে দিতে পারে। স্পাইওয়্যার আছে যা তোমার সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। এমনকি তোমার কম্পিউটারের পুরো নিয়ন্ত্রণ দূরের থেকে কেউ করতে পারে।

এখন আমরাতো ইতিমধ্যেই কিছু কিছু ছবি, সংখ্যা বা টেক্সট পাঠিয়েছি। এবং আগামী দিনে কিছু ছোটখাটো প্রোগ্রাম ফাইলও পাঠানো হবে এবং এটা ঠিক যে আমাদের কোন অসৎ উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু অন্য কোনও ভিনগ্রহী যে কোন ক্ষতিকারক সফটওয়্যার পাঠাবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ অ্যাস্ট্রোনটিক্সের নিয়ম অনুযায়ী যে কোন এ জাতীয় রেডিও বার্তা পেলে তা’ বিশ্লেষণের জন্য তাদের তালিকার অন্যান্য ইন্সস্টিটিউটকেও পাঠাতে হবে। যদি কোনও সময়ে কোনও রেডিও টেলিস্কোপের কম্পিউটারে কোনও নির্দিষ্ট গঠনের বার্তা পাওয়া যায় তা’ একদিকে যেমন যুগান্তকারি ঘটনা হবে অপরদিকে তা’ যদি ক্ষতিকারক কোনও ভাইরাস জাতীয় হয় তবে তা’ নিশ্চয়ই অনেক কম্পিউটার সিস্টেম যারা সেগুলো ডাউনলোড করবে – তাদের বিপুল ক্ষতিসাধন করবে। বিজ্ঞানীরা তাই এ বিষয়ে কি কি সতর্কতা নেওয়া যায় সে বিষয়েও ভাবনা চিন্তা করছেন।

আমি – “কিন্তু স্যার আমরা যদি নিজেদের থেকে বার্তা না পাঠাই তা’ হলেতো আর ভয় নেই!”

স্যার – “হ্যাঁ, তা হলে ভয় অনেকটাই কম কিন্তু পুরোপুরি নয়। ভিনগ্রহীদের উদ্দেশ্যে আমাদের বার্তা পাঠানোর অনেক আগে থেকে গত আট দশক ধরে আমাদের নিজেদের রেডিও টেলিভিশনের জন্য যত রেডিও বার্তা পাঠানো হয়েছে তাদের তরঙ্গ মহাকাশে ইতিমধ্যে বহুদূর ছড়িয়ে গেছে। যদিও তা’ খুবই ক্ষীণ তবুও কোনও অতি উন্নত সভ্যতা হয়তো তাদেরকে চিহ্নিত করে আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে পারে। যদি তারা আমাদের ক্ষতি করতেই চায় কে তাদের আটকাবে? যাক ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তা একমাত্র ভবিষ্যতই বলবে। ”

[সমাপ্ত]

Leave a comment