Month: June 2020

স্বামী বিবেকানন্দ – যুবশক্তির মূর্ত প্রতীক

 

স্বামী বিবেকানন্দ – আমাদের সবার স্বামীজী জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩ সাল – আজ থেকে ঠিক ১৫০ বছর আগে। তাই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে পালিত হচ্ছে তাঁর ১৫০-তম জন্ম-জয়ন্তী। ১৯৮৪ সালে ভারত সরকার ১২ই জানুয়ারী অর্থাৎ স্বামীজীর জন্মদিনের দিনটিকে জাতীয় যুব দিবস (National Youth Day) হিসাবে ঘোষনা করে। তাই ১৯৮৫ সাল থেকে প্রতি বছর এই দিনটি জাতীয় যুব দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। কারণ স্বামীজী যৌবনের প্রতীক – তিনি চিরতরুণ। তাঁর সমগ্র কর্মজীবন ও ইহজীবন সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর যৌবনকালের মধ্যে।

স্বামী বিবেকানন্দ যখন ইহলোক ত্যাগ করেন তখন তাঁর বয়স সাড়ে উনচল্লিশ – অর্থাৎ চল্লিশ বছর বয়সের আগেই। স্বামীজী নিজেও বলেছিলেন – আমি চল্লিশ পেরোচ্ছিনা। মানুষের জীবনে বয়সের কতকগুলি স্তর আছে – শৈশব, বাল্য, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বার্দ্ধক্য। এই চল্লিশ বছর বয়সটি মানুষের যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের সীমারেখা। আবার আঠার বছর বয়সটা মানুষের কৈশোর আর যৌবনের সীমারেখা ধরা যেতে পারে। মানুষের এই সতেরো-আঠার বছর বয়স থেকে চল্লিশ বছর বয়স পর্য্যন্ত জীবনের সময় কে যৌবনকাল বলা হয়।

এই যৌবনকালই মানুষের জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। এই কালেই মানুষের শক্তি, স্বাস্থ্য, মেধা, প্রতিভা, গুণ, দক্ষতা, কর্মক্ষমতা, হৃদয়বত্তা সব কিছুরই পূর্ন বিকাশ লাভ হয়। তাই এই যৌবনকাল মানুষের জীবনের সবথেকে কাম্য, প্রিয় ও প্রধান সময়। এই যৌবনকাল সাধারন ভোগবাদীদের ভোগের পক্ষে যেমন প্রকৃষ্ট তেমনি ঈশ্বরলাভেচ্ছু অধ্যাত্মবাদীদের ঈশ্বর আরাধনারও পক্ষেও উৎকৃষ্ট সময়।

স্বামীজীকে চাক্ষুষ দেখার দুর্লভ সৌভাগ্য আমাদের হয় নি – এমন কি স্বামীজীর সঙ্গলাভ করেছেন এমন বিরল ভাগ্যবানদের মধ্যে একজনকেই আমি আমার শৈশবে দূর থেকে দেখেছিলাম – তিনি তখন অশীতিপর বৃদ্ধ পূজনীয় জ্ঞান মহারাজ। তাই স্বামীজীর সাথে আমাদের পরিচয় তাঁর জীবনী, তাঁর বিভিন্ন ফটোগ্রাফ, তাঁর সম্বন্ধে রচিত বিভিন্ন স্মৃতিকথা ও তাঁর বাণী ও রচনার মাধ্যমে। স্বামীজীর সব জীবনীগ্রন্থে আমরা তাঁর জন্ম, শৈশব ও বাল্যকালের কয়েকটি পরিচ্ছেদ বাদে, বাকি শতকরা পঁচাশী ভাগই তাঁর আঠার বছর বয়সের সময় থেকে অর্থাৎ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের সময় থেকে তাঁর ইহলোক ত্যাগের সময়কাল পর্য্যন্ত তাঁর সম্পূর্ণ যৌবনকালের কর্মময় জীবনের বর্ননা পাই। তাঁর শৈশব, বাল্যকাল এমন কি তাঁর কৈশোরকালের কোনও ছবিও আমরা পাই নি। স্বামিজী বৃদ্ধ বয়সকাল অবধি বেঁচে থাকলে কি রকম দেখতে হতেন তা আমরা কখনও কল্পনাও করি না। তাই আমাদের চোখে, আমাদের মনে, আমাদের স্বপ্নে, আমাদের কল্পনায় স্বামীজী চিরযুবক।

স্বামীজীর পূর্বাশ্রমের নাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তখন ১৮৮১ সাল – নরেন্দ্রনাথের বয়স আঠারো। জেনারেল এ্যাসেমব্লিজ (বর্তমান স্কটিশচার্চ) কলেজে এফ এ ক্লাসে পড়েন। নজরকাড়া চেহারা – সুঠাম ব্যায়ামপুষ্ট শরীর, তেজব্যঞ্জক তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত সুন্দর মুখশ্রী। ইংরাজিতে রচনা লেখা ও বক্তৃতা দেওয়াতে বিশেষ পারদর্শী। এই বয়সেই ইতিহাস, ন্যায়শাস্ত্র, দর্শন ও সাহিত্যের পাশ্চাত্য পন্ডিতদের রচিত গ্রন্থসকল পড়া হয়ে গেছে। এই সময়ে ও পরবর্ত্তীকালে বি এ ক্লাসে পড়ার সময়তে কান্ট, হেগেল, শোপেনহাওয়ার ও স্পেনসরের মতন দার্শনিকদের রচনা আয়ত্ত করেন। হার্বার্ট স্পেনসরের মতবাদের কোনও কোনও অংশের সমালোচনা করে তাঁকে একটি চিঠি লেখেন এবং জগৎখ্যাত দার্শনিক তাতে বিশেষ প্রীত হয়ে নরেন্দ্রনাথকে সাধুবাদ জানিয়ে চিঠির উত্তর দেন। ফলে এ সময়ে তিনি খুবই তর্কপ্রিয় ছিলেন – কঠোর যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে বিরূদ্ধ পক্ষের মত খন্ডন করতে খুবই দক্ষ ছিলেন।

নরেন্দ্রনাথ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন তা বলে যে শুধুই তথাকথিত প্রতি ক্লাশে প্রথম হওয়া শিক্ষকদের প্রিয় ভাল ছেলের মতন কেবল মুখ বুজে পড়াশুনা করে যেতেন তা নয়। এন্ট্রান্সে মেধাতালিকায় নাম ছিল না – তবে ভালভাবে প্রথম বিভাগে পাশ করেছিলেন। আসলে নরেন্দ্রনাথ সেই ধরণের ছেলে ছিলেন যারা অত্যন্ত Intelligent ও Meritorious কিন্তু syllabus ভিত্তিক বই মুখস্থ করা studious type নয়। তিনি সারা বছর বন্ধুবান্ধব্দের সাথে আড্ডা মেরে, গান গেয়ে, খেলাধূলা করে, হো, হো করে কাটাতেন। পরীক্ষার আগে দেখলেন জ্যামিতি বা ইতিহাস কিছুই পড়া হয় নি – সারারাত পড়ে আয়ত্ত করে পরের দিন পরীক্ষা দিয়ে ভালভাবে পাশ করে এলেন। ছোটবেলা থেকেই স্বামীজী ছিলেন যেমন শ্রুতিধর তেমনি স্মৃতিধর। যা একবার পড়তেন বা শুনতেন তা আর ভুলতেন না।

শুধু লেখাপড়াই নয় – ছোটবেলা থেকেই নরেন্দ্রনাথ খেলাধুলাতেও বিশেষতঃ কুস্তি, সাঁতার, লাঠিখেলা, জিমন্যাস্টিক, ঘোড়ায় চড়ায় খুব পারদর্শী ছিলেন। সরল নির্দোষ আমোদ-প্রমোদ, রঙ্গকৌতুকেও তাঁর জুড়ি ছিল না। সেদিন পল্লী অঞ্চলের ছেলেদের তিনি সর্দার ছিলেন। এ দিকে আবার গান বাজনাতেও ওস্তাদ – বেণী ওস্তাদের কাছে চার-পাঁচ বছর সঙ্গীত শিক্ষা করেছেন – সুকন্ঠ গায়ক হিসাবে বেশ নাম-ডাক ছিল।

সদ্যযুবক নরেন্দ্রনাথের চরিত্রের সর্বপ্রধান গুণ ছিল – পবিত্রতা ও নির্মলতা – যা সেই সময়কার কলকাতার যুবকদের মধ্যে দেখা যেত না বললেই চলে। তাঁর যৌবন কালের এক বন্ধু বলেছিলেন – “তিনি পবিত্রতার জলন্ত বিগ্রহ ছিলেন”। বেলুর মঠের জনৈক সাধু একবার মিস ম্যাকলাউডকে এক কথায় স্বামীজীকে বর্ণনা করতে বলেছিলেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন – “Not only he was holy, but he was holiness” – তিনি শুধু পবিত্রই ছিলেন না – তিনি ছিলেন পবিত্রতা। কলকাতার মতন শহরে এত বড় স্বত্ত্বগুণী আধার থাকাও সম্ভব দেখে স্ব্য়ং ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও অবাক হয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ঈশ্বরানুরাগী। বাল্যকালে ধ্যান করা তাঁর খেলা ছিল – যৌবনে এক এক সময়ে সমস্ত রাত্রি ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। নরেন্দ্রনাথ অতিশয় চিন্তাশীল ছিলেন – বিনা যুক্তিতে কোনও বিষয়ে বিশ্বাস বা গ্রাহ্য করা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। এখন ঈশ্বরকে তো আর যুক্তি-বিচার দিয়ে জানা যায় না – তাই স্বভাবতঃই এই সময়ে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্বে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন। ধর্মভাবের তীব্র প্রেরণায় এই সময়ে তিনি অখন্ড ব্রহ্মচর্যপালন ও কঠোর তপস্যা করতেন। অথচ তিনি যে কারুর বা কোনও গুরুর নির্দেশে সাধনা করতেন তা নয় – এ তাঁর সহজাত ছিল।

ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে নরেন্দ্রনাথ যখন এলেন তখন তিনি আঠার বছরের প্রাণোচ্ছল এক তরতাজা টগবগে নব্য যুবক। ঠাকুরের কাছে সেই সময়ে আরও অনেক যুবক ভক্ত এসেছিলেন। তাঁরা ছিলেন অনেক শান্ত ও বাধ্য। ঠাকুর যা বলতেন – মুখ বুঁজে মেনে নিতেন। কিন্তু নরেন্দ্রনাথ তা’ নন – ঠাকুরের সাথে তর্ক করতেন – যতক্ষন নিজে অন্তর থেকে না বুঝতেন ততক্ষণ কোনও কথাকে মেনে নিতেন না। কিন্তু ঠাকুর নরেন্দ্রনাথকেই সবথেকে বেশী ভালবাসতেন। নরেন্দ্রের প্রশংসায় ঠাকুর পঞ্চমুখ হতেন। – নরেন্দ্র ঈশ্বরকোটি, নিত্যসিদ্ধ – দেখ গা নরেন্দ্র কাহাকেও কেয়ার করে না… আমারই অপেক্ষা রাখে না। … মায়ামোহ নাই, কোনও বন্ধন নাই। খুব ভাল আধার। একাধারে অনেক গুণ, গাইতে, বাজাতে, লিখতে, পড়তে। এদিকে জিতেন্দ্রিয় – বলেছে বিয়ে করবে না। নরেন্দ্রকে ঠাকুর বলতেন ‘খাপখোলা তলোয়ার’। একজন সৎ চরিত্রবান অথচ হাসিখুসী প্রাণবন্ত যুবকের যত রকম গুণ থাকতে পারে – নরেন্দ্রনাথের মধ্যে তার পূর্ণ বিকাশ দেখা যায়।

মানুষের সব গুণের বিকাশ যৌবনেই পরিপূর্ণতা লাভ করে। স্বামীজীর সব গুণাবলীর আলোচনা করতে গেলে আর এক মহাভারত হয়ে যাবে। ১৯৬৩ সালে উদ্বোধন পত্রিকার স্বামীজীর শতবর্ষ-জয়ন্তী-সংখ্যায় একটি নিবন্ধে পড়েছিলাম – স্বামীজীর মধ্যে ছিল বুদ্ধের হৃদয়, শঙ্করের মেধা, শ্রীচৈতন্যের প্রেম ও সাধু পলের বাগ্মীতা। এই চারটি বিশেষত্ব নিয়ে সামান্য কয়েকটি কথা এখানে বলা যেতে পারে।

বুদ্ধদেব বা গৌতম বুদ্ধ আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে বর্তমান নেপালের কপিলাবস্তুর রাজবংশে রাজকুমার সিদ্ধার্থ নামে জন্মগ্রহণ করেন। রাজপুত্ররূপে, রাজসুখে আজীবন লালিত-পালিত হয়েছেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট কাকে বলে জানতেন না। যৌবনে রথে রাজপথে বেড়াতে গিয়ে তিনি রোগগ্রস্ত, জ্বরাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও মৃত্যুশোক দেখে অত্যন্ত বিচলিত হন। আর একদিন এক শান্ত, আনন্দময় সন্ন্যাসীকে দেখে তিনি স্থির করেন যে মানুষের রোগ-শোক-দুঃখ-কষ্ট-মৃত্যু থেকে নির্বানলাভের উপায় তাঁকে খুঁজে পেতে হবে ও সাধারন মানুষকে তার পথ দেখাতে হবে। তিনি যৌবনে ২৯ বছর বয়সে স্ত্রী-শিশুপুত্র-রাজসুখ ও রাজ্য পরিত্যাগ করে প্রবজ্যা গ্রহণ করে দীর্ঘ তপস্যায় ব্রতী হন – যাঁকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ কাব্যে বর্ণনা করেছেন – তারি লাগি রাজপুত্র পরিয়াছে ছিন্নকন্থা, বিষয়ে বিবাগী, পথের ভিক্ষুক। উদারহৃদয় বুদ্ধদেবকে বিষ্ণুর দশবতারের অন্যতমরূপে গণ্য করা হয়ে থাকে।

বুদ্ধদেবের প্রতি স্বামীজীর বিশেষ শ্রদ্ধা-ভক্তি ছিল – তাঁর মতে বুদ্ধদেব ছিলেন ত্যাগ ও করুণার অবতার। সকল মানুষ এমন কি সকল প্রাণীর প্রতি বুদ্ধদেবের দয়া, অপরের দুঃখে সংবেদনশীলতার কথা স্বামীজী বহু সময়ে শ্রদ্ধার সাথে বলেছেন। বালক অবস্থায় ধ্যান করতে করতে তাঁর মতে তিনি বুদ্ধদেবের দর্শন লাভ করেছিলেন। কাশীপুরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চিকিৎসার সময়ে স্বামীজী তার দু’জন গুরুভাইয়ের সাথে বুদ্ধগয়া যান ও সেখানে তপস্যা করেন। হৃদয়বত্তার দিক দিয়ে বুদ্ধপ্রেমিক স্বামীজী নিজেও ছিলেন দ্বিতীয় বুদ্ধদেব। তাঁর মতন প্রতিভাবান যুবক ভোগ-সুখের সংসারে একজন নামকরা ক্ষমতাবান জননেতা বা নামজাদা ব্যারিষ্টার বা উচ্চ পদের সরকারি আমলা হওয়া অনায়াসাধ্য ছিল। কিন্তু যৌবনের প্রারম্ভেই তিনি সংসারসুখ ত্যাগ করে সন্ন্যাসের উচ্চ আদর্শ গ্রহণ করেন। বুদ্ধদেবের মতনই তিনি দুঃখকষ্টে জর্জরিত সাধারণ মানুষের প্রতি করূণায় বিগলিত হয়ে দর্শন চর্চার চেয়ে দুঃখ ত্রাণের জন্য জীবন চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।

সঙ্ঘবদ্ধ না হলে কোনও বড় কাজ করা যায় না। তাই বুদ্ধদেব তাঁর ত্যাগী শিষ্যদের নিয়ে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁর সাধনলব্ধ জ্ঞান ও আদর্শকে প্রচারের জন্য যা সাধারণ মানুষের মধ্যে আনবে অহিংসা, প্রেম, শান্তি ও মৈত্রী। বৌদ্ধধর্মের মন্ত্রেই উচ্চারণ করা হয় – সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। বুদ্ধদেবের মতন স্বামীজীও তাঁর গুরুভাইদের, শিষ্যদের ও অনুরাগীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘ যার প্রধান উদ্দেশ্য ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের বর্তমান যুগের পক্ষে প্রযোয্য শিক্ষা ও আদর্শের উপর ভিত্তি করে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের বিশেষতঃ দরিদ্র, অশিক্ষিত ও অবহেলিত মানুষদের অর্থ-সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি।

অনেকের মতে বুদ্ধদেব বেদবিরোধী নাস্তিক। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু তা হলে তিনি কার তপস্যা করেছিলেন? তাঁর প্রচারিত বাণী ও আদর্শ পরবর্ত্তী কালে সনাতন হিন্দুধর্ম থেকে আলাদা হয়ে বৌদ্ধধর্মরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বামীজী কিন্তু বুদ্ধদেবকে অদ্বৈতবাদী ও হিন্দুধর্মের সংস্কারক বলে বিশ্বাস করতেন ও মনে করতেন যে বুদ্ধই বনের বেদান্তকে সাধারণ মানুষের উপযোগী করে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করেছেন।

ভগবান বুদ্ধের মতন জগদগুরু শঙ্করাচার্য ভারতবর্ষের দর্শন ও সাধনার একজন দিকপাল। বুদ্ধদেবের কালের প্রায় হাজার বছরেরও বেশী পরে শঙ্করাচার্যের আবির্ভাব। তিনি ছিলেন সনাতন ধর্মের ভিত্তি বেদান্তের এক অতুলনীয় ভাস্যকার, অদ্বৈতবাদী দার্শনিক ও বৌদ্ধধর্মের প্লাবনে মৃতপ্রায় সনাতন ধর্মের পরিত্রাতা।

খ্রীষ্টীয় ৭৮৮ সালে কেরালার কালাদি নামক গ্রামে শঙ্করাচার্য্যের জন্ম। মাত্র আট বছর বয়সে তিনি নিজে সন্ন্যাসগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিরল শ্রেণীর প্রতিভাবান ও মেধাবী। তাঁকে বলা হোতো এক-শ্রুতিধর অর্থাৎ যিনি যে কোনও বিষয় মাত্র একবার পড়ে বা শুনে আয়ত্ত করতে পারেন। আট থেকে ষোল বছর বয়সের মধ্যে তিনি বেদ-বেদান্ত-পুরাণ ও অন্যান্য শাস্ত্রে পান্ডিত্য লাভ করেন। সুতার্কিক হওয়ার ফলে তিনি তৎকালীন ভারতে বিভিন্ন দর্শনের মধ্যে অদ্বৈত-বেদান্ত মতকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরবর্ত্তীকাল থেকে বর্তমানকাল পর্য্যন্ত ভারতবর্ষের প্রায় সকল সন্ন্যাসী-সম্প্রদায়ের আদি-গুরুরূপে তিনি স্বীকৃত হয়ে আসছেন। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়। একমাত্র স্বামীজী ছাড়া তাঁর মতন বিরলতম প্রতিভার তুলনা নেই। শুধু তাই নয় আচার্য শঙ্করের সাথে স্বামীজীর বহুক্ষেত্রে আশ্চর্য্য রকমের মিল আছে। উভয়ই যতিরাজ অর্থাৎ উচ্চতম স্তরের সন্ন্যাসী। উভয়ের জ্ঞান, পান্ডিত্য, মেধা, মণীষা ও বহুমুখি প্রতিভার সমতুল্য তৃতীয় কেউ আছে বলে মনে হয় না। উভয়ই মহোত্তম আচার্য এবং অদ্বৈত বেদান্ত মতের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রচারক।

১৮৯৩ সালে শিকাগোতে ধর্ম-মহাসভায় যোগদানের জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রীক ভাষার অধ্যাপক রাইট মাত্র চার ঘন্টা আলাপের পর স্বামীজীকে যে পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন তাতে স্বামীজী সম্বন্ধে লিখেছিলেন যে ইনি এমন একজন ব্যক্তি যার জ্ঞান আমাদের সকল অধ্যাপকদের সন্মিলিত জ্ঞানের থেকেও বেশী। স্বামীজীর জ্ঞান ছিল বহুমুখী – প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্যের সমগ্র দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্যের খ্যাতনামা লোকেদের রচনা তাঁর কন্ঠস্থ ছিল। এ ছাড়া সঙ্গীত, শিল্প, ভাস্কর্য, আধুনিক বিজ্ঞান এবং বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও সমাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান ও পান্ডিত্য বিদগ্ধজনদের মুগ্ধ ও স্তম্ভিত করত। আসলে আচার্য শঙ্করের মতন স্বামীজীও ছিলেন একশ্রুতিধর। যা একবার শুনতেন, দেখতেন বা পড়তেন তা’ কখনোই ভুলতেন না – এমন কি বহুকাল পরেও পড়া বই থেকে লাইনের পর লাইন হুবহু উদ্ধৃত করতে পারতেন।

স্বামীজী ছিলেন বুদ্ধদেব ও আচার্য শঙ্করের এক সুষ্ঠ সমন্বয়। বুদ্ধদেব বিতর্ক-বিচারের চেয়ে নৈতিক আচার-আচরণ, বুদ্ধির চেয়ে হৃদয়ের ও মননের চেয়ে জীবনের ওপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। অপর দিকে জ্ঞানমার্গের পথিক আচার্য শঙ্কর আচার-আচরণের চেয়ে তাত্ত্বিক বিচার, শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসনের ওপর বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন। তাই বুদ্ধদেব ও শঙ্করের মধ্যে যেন একটা আপাতবিরোধ আছে বলে মনে করা হয়। বর্তমান যুগে সকল ধর্মের, সকল মতের সমন্বয়ের কথা যিনি বার বার বলেছেন সেই যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য স্বামীজী এই তথাকথিত আপাতবিরোধের কোনও গুরুত্বই দেন নি। বরঞ্চ স্বামীজী এই দুই মহাপুরুষের সমন্বিত আদর্শের কথাই বলেছেন। একদিকে শঙ্করাচার্যের প্রতি স্বামীজির ছিল অপরিসীম শ্রদ্ধা, অপরদিকে তিনি ছিলেন বুদ্ধদেবের এক অনুরক্ত ভক্ত। স্বামীজী বুদ্ধদেবকে শঙ্করাচার্যের মতনই অদ্বৈতবাদী ও হিন্দুধর্মের সংস্কারক বলে মনে করতেন। স্বামীজী যে আদর্শ মানুষের কথা বলেছেন তা এই দুই মহিমান্বিত ব্যাক্তিত্বের সমন্বয়। স্বামীজী লন্ডনে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বলেছিলেন – “We want harmony, not one-sided development. And it is possible to have the intellect of a Shankar with the heart of a Buddha. I hope we shall all struggle to attain to that blessed combination.” স্বামীজীর এ শুধু মুখের কথা নয় – তিনি নিজেই ছিলেন এই দুইয়ের সমন্বিত আদর্শ।

স্বামীজী ছিলেন শঙ্করাচার্যের মতন একজন আদর্শ অদ্বৈতবাদী কঠোর সন্ন্যাসী – তা বলে জগতকে স্বপ্নবৎ বা মায়া বলে উড়িয়ে দিয়ে আত্মচিন্তায় মগ্ন হয়ে বসে থাকেন নি। বরঞ্চ বুদ্ধদেবের মতন হৃদয়বান স্বামীজী জীবের দুঃখে কাতর হয়ে জীবের কল্যাণের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। শংকরের মায়াবাদের প্রকৃত ব্যাখ্যা তিনি তাঁর জ্ঞানযোগ বইতে করেছেন। এ ক্ষেত্রে মায়া আসলে কোনও Illusion বা স্বপ্নবৎ মিথ্যা ভ্রম জাতীয় কিছু নয়। এখানে মায়া হল অজ্ঞানতা। অর্থাৎ এ বিশ্ব-জগতে একমাত্র ঈশ্বরেরই অস্তিত্ব আছে-আর কিছুরই নেই। জগতে সকল প্রাণী সকল বস্তুই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের প্রকাশ মাত্র। প্রকাশের মাত্রার তারতম্যের ভেদের জন্যই সব আলাদা মনে হয়। মানুষের মধ্যে ঈশ্বরে প্রকাশ সব থেকে বেশী। আমরা প্রতিটি মানুষই ঈশ্বরের degenerated state বা পতিত অবস্থা। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরে উন্নীত হবার ক্ষমতা আছে। তাই স্বামীজী বলেছিলেন Each soul is potentially divine। এ চরম সত্যটি যে অজ্ঞানতার জন্য আমরা ভুলে আছি তারই নাম মায়া। জীবাত্মাই পরমাত্মা – এ তত্ত্ব মহাজ্ঞানী শঙ্করাচার্য দেখিয়েছেন প্রখর জ্ঞানের আলোতে – মহাপ্রাণ বুদ্ধদেব দেখিয়েছেন হৃদয়ের আলোতে – প্রেম, মৈত্রী ও শান্তির মাধ্যমে।

যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণের যে আদর্শ ও ভাবধারা স্বামীজী জগতে প্রচার করেছেন – তার একটি প্রধান ভাব ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’। বৈষ্ণব ধর্মে আছে ‘জীবে দয়া’ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবস্থায় একদিন বলেছিলেন – “জীবে দয়া! দূর শালা! কীটানুকীট তুই, জীবকে দয়া করবি? দয়া করবার তুই কে? না না জীবে দয়া নয় – শিবজ্ঞানে জীবের সেবা”।

ভাবাবিষ্ট ঠাকুরের কথা সেদিন উপস্থিত সকলেই শুনেছিলেন কিন্তু তার গুঢ় মর্ম কেউই বুঝতে বা ধারণা করতে পারেন নি। ঠাকুরের প্রধান শিষ্য নরেন্দ্রনাথ একমাত্র সেদিন ঠাকুরের এই ‘শিবজ্ঞানে জীবের সেবা’ কথার মধ্যে জ্ঞান-ভক্তি সমন্বিত এক নতুন আলোর সন্ধান পেয়েছিলেন। তিনি হৃদয়ঙ্গম করেছিলন যে অদ্বৈতজ্ঞান লাভের জন্য সংসার ও লোকসঙ্গ ছেড়ে, ভক্তি ভালোবাসা জলাঞ্জলি দিয়ে গভীর বনে গিয়ে নির্জ্জনে তপস্যার প্রয়োজন হয় না – বরং বনের বেদান্তকে ঘরে এনে সংসারের সকল কাজ তাকে অবলম্বন করেই করা যায়। মানুষের মনে এই বিশ্বাস ও ধারণা আসতে হবে যে এক ঈশ্বরই জীব ও জগৎরূপে তার সামনে প্রকাশিত হচ্ছেন। সংসারের সকল ব্যাক্তিই ঈশ্বরের অংশ এবং তাদের সকলকে শিবজ্ঞান করতে পারলে – অপরের প্রতি দ্বেষ, দম্ভ বা দয়ার অবকাশ থাকে না। শিবজ্ঞানে সকল জীবের সেবা করতে পারলে চিত্ত শুদ্ধ হয়ে মানুষ অল্পকালেই নিজেকে চিদানন্দময় ঈশ্বরের অংশ বলে ধারণা করতে পারবে।

পরিব্রাজক অবস্থায় সারা ভারত পরিভ্রমণ করতে গিয়ে দেখেছিলেন লক্ষ-কোটি দরিদ্র, মূর্খ ভারতবাসী কি ভাবে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটায় – না আছে এদের মাথা গোঁজবার ঠাঁই, না আছে কোনও শিক্ষা – রোগ হলে মৃত্যুই একমাত্র পরিণতি। এদের মধ্য দিয়েই স্বামীজী শুরু করেছিলেন শিবজ্ঞানে জীবসেবার কাজ। এই উদ্দেশ্যেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রামকৃষ্ণ মিশন। ভারতীয় সন্ন্যাসের শাশ্বত আদর্শ ‘আত্মন মোক্ষার্থং’ – এর সাথে যুক্ত করেছিলেন নতুন কর্মযোগের লক্ষ্য ‘জগদ্ধিতায় চ’।

প্রাচীন ভারতের দুই ধর্ম সংস্কারক মহাপুরুষ বুদ্ধদেব ও শঙ্করাচার্যের এক সমন্বয় আমরা দেখতে পাই বর্তমান ভারতের আর এক মহাপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যে – যিনি একদিকে ধর্ম সংস্কারক ও অপরদিকে সমাজ সংস্কারক – বলতে গেলে সামগ্রিকভাবে মানবাত্মার সংস্কারক। বুদ্ধদেবের হৃদয় ও আচার্য শঙ্করের মেধার সমন্বয়ের যে আদর্শ মানুষের কথা স্বামীজী বলেছেন – স্বামীজী স্বয়ং সেই আদর্শ মানুষ। যেহেতু স্বামীজীকে আমরা তাঁর যৌবনকালেই শুধু পেয়েছি তাই তিনি একজন আদর্শ যুবক – প্রকৃত যুবশক্তির মূর্ত প্রতীক।

স্বামীজীর কর্মজীবন ও চারিত্রিক বিশেষত্ব নিয়ে অনেক বিশ্লেষন করা হয়ছে-অনেক মূল্যায়ন করা হয়েছে – অনেক উচ্চমানের প্রবন্ধ লেখা হয়েছে – স্বামীজীকে জানবার-চেনবার–বোঝবার চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও স্বামীজীকে আমরা কতটুকু জানতে পেরেছি – কতটুকু চিনতে পেরেছি জানি না। মনে হয় এতে করে স্বামীজীর এক-চতুর্থাংশ হয়তো জেনেছি – বাকি তিন-চতুর্থাংশ স্বামীজী আমাদের কাছে অজানা। স্বামীজীর কথার অনুসরন করে বলা যাতে পারে যে আর একটি স্বামী বিবেকানন্দ জন্মালে তিনি একমাত্র জানতে পারতেন স্বামীজী কে ও কি ছিলেন।